হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় তিন থেকে চারগুণ বেশি। বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ করোনা সংক্রমণের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত প্রতিদিন এ রোগে মৃত্যুর হার গড়ে ২৫ জনের ওপর। তাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশির বয়স ৬০ বছরের বেশি, যাদের একটি বড় অংশই রক্তচাপ, হৃদরোগসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তাই হৃদরোগ আছে- এমন ব্যক্তিদের শুরু থেকেই সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন প্রেক্ষাপটে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব হার্ট দিবস। এবার এ দিবসটির প্রতিপাদ্য- ‘বৈশ্বিক মহামারিতে হৃদরোগীদের প্রতি হৃদয়বান হোন।’ দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
হৃদরোগীদের মৃত্যুঝুঁকি: হৃদরোগজনিত সমস্যা আছে, করোনাভাইরাস সংক্রমিত হলে এমন ব্যক্তির মৃত্যুঝুঁকি কেমন?- সম্প্রতি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগ ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগ সারাবিশ্বে পরিচালিত উল্লেখযোগ্য ৪১টি গবেষণাপত্রকে বৈজ্ঞানিক বিশ্নেষণের মাধ্যমে এ প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করে। এতে দেখা গেছে, করোনা আক্রান্তের মধ্যে যাদের আগে থেকে কোনো দীর্ঘমেয়াদি রোগ ছিল, তাদের বেশিরভাগই মারা গেছেন। উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগে ভুগছেন- এমন ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হলে মৃত্যুঝুঁকি শুধু আক্রান্তদের চেয়ে প্রায় তিন থেকে চারগুণ বেশি।
গবেষণায় বলা হয়, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে বিদ্যমান কিছু রোগ বা কোমরবিডিটি- যেমন উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের প্রাদুর্ভাব তুলনামূলক বেশি। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের মধ্যে ৩৬ দশমিক ৫, হৃদরোগীদের মধ্যে ১১ দশমিক ৯ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের মধ্যে ২২ শতাংশ মানুষ করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়েছেন।
দেশে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগে আক্রান্তদের সতর্ক করে গবেষণায় বলা হয়, বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল দেশে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের কারণে উচ্চঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সতর্ক বার্তা দিচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০১৫ সালের এক জরিপের কথা উল্লেখ করে এতে বলা হয়, ওই জরিপ অনুযায়ী দেশে ২০ শতাংশ পুরুষ এবং ৩২ শতাংশ নারী উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। এ ছাড়া ২০১৮ সালের আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে প্রতিবছর হৃদরোগজনিত কারণে দুই লাখ ৭৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
ইউরোপিয়ান হার্ট জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা হৃদরোগীদের মৃত্যুঝুঁকি অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। চীন ও আয়ারল্যান্ডের একদল গবেষক চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত চীনের উহানের হুশেনশান হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। এতে দেখা যায়, ৮৫০ করোনা আক্রান্ত রোগী, যাদের প্রায় ৩০ শতাংশের হৃদরোগজনিত সমস্যা ছিল, তাদের মধ্যে ৪ শতাংশ মারা গেছেন। অন্যদিকে হৃদরোগজনিত সমস্যা নেই, করোনা আক্রান্ত এমন দুই হাজার ২৭ রোগীর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে মাত্র এক শতাংশের।
বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত ও মৃত ব্যক্তিদের ওপর এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়নি। তবে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) করোনায় আক্রান্ত ও মৃত ব্যক্তিদের ওপর একটি পর্যালোচনা শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর সমকালকে বলেন, হৃদরোগজনিত সমস্যায় থাকা ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হলে তার মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেশি। দেশে এ পর্যন্ত করোনায় মৃতদের অধিকাংশের হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, লিভারসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত এবং মৃতদের অধিকাংশের কোমরবিডিটি রয়েছে। এ বিষয়ে আইইডিসিআর এক পর্যালোচনা শুরু করেছে। এটি শেষ হলে নির্দিষ্ট করে বলা যাবে, কত শতাংশ কোন রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
সতর্ক থাকার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের: জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. আফজালুর রহমান বলেন, হৃদযন্ত্রে অনেক কারণেই করোনার সংক্রমণ হতে পারে। এই ভাইরাস সরাসরি হৃদযন্ত্রকে আক্রান্ত করতে পারে। মায়োকার্ডাইটিসের কারণে প্রদাহ হলে এটি প্রথমেই হৃদযন্ত্রকে আক্রান্ত করে না। ফুসফুস এবং অন্যান্য অঙ্গে সংক্রমণ হলে এমনটি হয়। ওই মায়োকার্ডাইটিস থেকে হৃদযন্ত্রের পেশির প্রদাহ হয়। এখান থেকে কার্ডিয়াক এরিথমিয়া হতে পারে। এর ফলে এটি হার্টকে আঘাত করতে পারে অর্থাৎ অ্যাকিউট কার্ডিয়াক ইনজুরি হতে পারে। যারা হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, স্ট্রোক হয়েছে, বাইপাস সার্জারি করা হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে করোনার সংক্রমণ অধিক ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, এসব ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হলে জ্বরের পাশাপাশি কাশি হতে পারে। সেখান থেকে নিউমোনিয়া অথবা বুকে তীব্র ব্যথা ও চাপ অনুভব করতে পারেন। ফলে মনে হতে পারে এটি হার্ট অ্যাটাক। এ ধরনের সমস্যা হলে ইসিজি করে দেখতে হবে। অনেক সময় ওই উপসর্গ হার্ট অ্যাটাকের ইসিজির মতো দেখা যায়। কার্ডিয়াক এনজাইম ট্রপোনিন টেস্ট, সিপিকে-এমবি অনেক সময় বেশি থাকলেও ভুলবশত হার্ট অ্যাটাক রোগীর মতো চিকিৎসা হতে পারে। যদিও এটি হার্ট অ্যাটাক নয়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। সুতরাং চিকিৎসা শুরুর আগে এসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী সমকালকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগে ভুগছেন, তাদের জন্য কভিড-১৯ মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের। তাদের মধ্যে যারা ধূমপান, অ্যালকোহল ও চর্বিজাতীয় খাবার খান তারাও ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং, সতর্কতা অবলম্বনের বিকল্প নেই।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুল মালিক বলেন, বৈশ্বিক করোনা মহামারির এই সময়ে হৃদরোগীরা দ্বিমুখী সমস্যার মধ্যে রয়েছেন। একদিকে করোনায় আক্রান্ত হলে হৃদরোগীদের জটিলতা বাড়তে পারে। অন্যদিকে সংক্রমণের ভয়ে তারা হার্টের নিয়মিত চেকআপ ও চিকিৎসা থেকে বিরত থাকলেও মারাত্মক ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। কারণ, হার্ট অ্যাটাক কিংবা স্ট্রোকের জটিলতা করোনার মতোই ভয়াবহ। আমরা একটি অপ্রত্যাশিত ও অদৃশ্য সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছি। জানি না করোনা মহামারি কোথায় গিয়ে থামবে। করোনার এই সময়ে হার্টের যত্ন নেওয়া অন্য যে কোনো সময়ে চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
হৃদরোগের চিকিৎসাও সংকটে: ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে গত বছর কার্ডিয়াক সার্জারি ইউনিট চালু করা হয়েছে। তবে কার্ডিওলজি বিভাগটি দীর্ঘদিন ধরে চালু আছে। দুটি বিভাগই চলছে সীমিত পরিসরে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেরও একই চিত্র। অন্যদিকে রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের পুরোনো আটটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সীমিত পরিসরে কার্ডিওলজি থাকলেও কার্ডিয়াক সার্জারি চিকিৎসার সুযোগ নেই। নতুন প্রতিষ্ঠিত মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কোনোটিতেই হৃদরোগের চিকিৎসা নেই। এ অবস্থায় সরকারি বিশেষায়িত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ওপরই এ চিকিৎসা নির্ভরশীল। যেখানে চিকিৎসা নিতে গিয়ে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়তে হয় রোগীদের।
সরকারি হাসপাতালের অন্তত পাঁচজন পরিচালক ও চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, যন্ত্রপাতি, জনবলসহ নানামুখী সংকটের কারণে দেশের জেলা সদরের সরকারি হাসপাতালগুলোতে হৃদরোগ সেবা বিশেষ করে কার্ডিয়াক সার্জারি চিকিৎসা খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। আটটি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে অল্পবিস্তর হৃদরোগ সেবা দেওয়া হচ্ছে। এসব হাসপাতালে ক্যাথল্যাবের পাশাপাশি টিএমএলআর মেশিন, স্টিম সেল, রেনাল কার্ড, ইসিপি থেরাপি মেশিন বছরের পর বছর ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে। করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) এবং লজিস্টিক সাপোর্টের অভাবে স্থানীয় চিকিৎসকরা রোগীকে ঢাকায় রেফার করতে বাধ্য হন। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে রাজধানীর সেবাকেন্দ্রে আনার পথেই অনেক রোগী মারা যাচ্ছেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, দেশে হৃদরোগের চিকিৎসা আগের তুলনায় অনেক এগিয়েছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে দেশে হৃদরোগের চিকিৎসা সম্প্রসারিত হয়েছে। এতে করে রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখিতা কমেছে। প্রতিবছরই হৃদরোগের চিকিৎসা সম্প্রসারিত হচ্ছে। বিশেষ করে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নতুন সম্প্রসারিত ভবন ও চিকিৎসাও সম্প্রসারিত হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে হৃদরোগ ইউনিট সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সুতরাং হৃদরোগ চিকিৎসা নিয়ে সংকট থাকবে না বলে মনে করছেন তিনি।
কর্মসূচি :দিবসটি উপলক্ষে এবার জাতীয় পর্যায়ে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন ভার্চুয়াল আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। এর বাইরে করোনা পরিস্থিতির কারণে আলোচনা সভা, শোভাযাত্রাসহ অন্য কোনো কর্মসূচি রাখা হয়নি।
সূত্রঃ সমকাল