ডেঙ্গুর উপসর্গে বদল: বেশি ঝুঁকিতে শিশুরা, ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে

0
283
dengue
Spread the love

ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ার পাশাপাশি বদলে গেছে ডেঙ্গুর উপসর্গ। লক্ষণ বদলে যাওয়ায় ডেঙ্গু হয়েছে তা বুঝতে না পারার কারণে হাসপাতালে যেতে দেরি করছেন রোগীরা। শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে যাওয়ায় দ্রুত রোগী শকে চলে যাচ্ছেন, অনেকেই মারা যাচ্ছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, সোমবার (১০ জুলাই) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৮৯ জন, মারা গেছেন তিনজন। এ বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন ১৩ হাজার ৮৪৩, মারা গেছেন ৭৬ জন। বর্তমানে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩ হাজার ২৫৩ জন। এর মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি আছেন ২ হাজার ৮০ জন। হাসপাতালগুলোয় প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি বাড়ছে।

ডেঙ্গুর লক্ষণ বদলে যাওয়ায় যে কোনো ধরনের শারীরিক অসুস্থতায় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি ডেঙ্গু মোকাবিলায় মশা নিধন ও ব্যক্তিগত সতর্কতা জরুরি বলে মনে করেন তারা। তীব্র জ্বর, শরীরে তীব্র ব্যথা, মাথাব্যথা, চেখের পেছনে ব্যথা, শরীরে র‌্যাশ ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণ।

তবে চলতি বছর এসব উপসর্গের বাইরে এমন সব লক্ষণ নিয়ে রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন যা ডেঙ্গুর প্রথাগত উপসর্গ নয়। সেকেন্ড বা থার্ড টাইম ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের এসব উপসর্গ বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এবার অল্প জ্বর, সর্দি-কাশি মাথাব্যথার দুই-তিন দিনের মধ্যে রোগীর অবস্থা জটিল হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই অজ্ঞান হয়ে যান, পালস, ব্লাড প্রেশার পাওয়া যায় না, এটিকে ডেঙ্গুর মডিফাইড ফর্ম বলে। এ সমস্যাগুলো আমাকে একটু ভাবিয়ে তুলছে। সাধারণ লক্ষণগুলো বদলে যাওয়ায় রোগী বুঝতে পারেন না, ফলে দেরিতে হাসপাতালে যাচ্ছেন।

তিনি আরও বলেন, এখন জ্বর, সর্দি, কাশি, ব্যথা হলে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যাবে না। ডেঙ্গু টেস্টে পজিটিভ এলে ৯০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগী বাড়িতে থেকে ডাক্তারের পরামর্শ মতো চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারবে। তবে বমি হলে, খেতে না পারলে, প্রেশার কমলে, হাসপাতালে যেতে হবে। ডায়াবেটিস, হার্টের রোগী বা অন্য কোনো জটিলতা আছে, বয়স্ক মানুষ, শিশু ও গর্ভবতী নারীদের ডেঙ্গু পজিটিভ হলেই হাসপাতালে যেতে হবে।

সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি আছেন রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে। হাসপাতালের পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, এ বছর ডায়রিয়া, অল্প জ্বর বা জ্বর না থাকা, দুই-তিন দিন ধরে বমি, মস্তিষ্কে প্রদাহ, বুকে এবং পেটে পানি জমে যাওয়া, অসহ্য রকমে পেট ব্যথাসহ বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ নিয়ে আসছেন রোগীরা। যারা দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা এসব লক্ষণ নিয়ে আসছেন। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তদের একটি বড় অংশ দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত এবং এদের জটিলতা বেশি।

তিনি আরও বলেন, কারও জ্বর কমার পর বমি শুরু হয়। দুই-তিন দিন বমি কমে না, অনেকের রক্তচাপ খুঁজে পাওয়া যায় না, প্রসাব বন্ধ হয়ে যাওয়া। এবার মাল্টি-অরগান ডিসফাংশন সিনড্রোমের রোগী আমরা অনেক পাচ্ছি। এ ধরনের রোগীদের সরাসরি আইসিইউতে পাঠাতে হচ্ছে। শিশুরা জ্বরের পাশাপাশি বমি ও পাতলা পায়খানায় আক্রান্ত হচ্ছে বেশি।

মাতুয়াইল শিশু ও মাতৃসদনের শিশু রোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. তানিয়া ইসলাম বলেন, ‘আগে শিশুদের ডেঙ্গু হলে জ্বর নিয়ে বেশি রোগী আসত। একটু বড় শিশুদের মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা হতো, খেতে চাইত না। বমিও হতো, তবে পাতলা পায়খানা তেমন পাওয়া যেত না। এবার বমি ও পাতলা পায়খানায় আক্রান্ত বেশি পাচ্ছি।

শিশুদের ডেঙ্গু থেকে সুরক্ষিত রাখতে অভিভাবকদের সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বাসার আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। শিশু দুপুরে যদি ঘুমায় মশারি দিয়ে ঘুম পাড়াতে হবে। শিশুর হাতে-পায়ে যাতে মশা না কামড়ায় সেসব ক্রিম লাগানো যেতে পারে। যদি কোনো কারণে শিশুর জ্বর চলে আসে তাহলে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে না খাইয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
ডেঙ্গু দ্রুত শনাক্ত হলে ম্যানেজমেন্ট সহজ হয়। শিশুর অবস্থার অবনতি হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মাসব্যাপী মশক নিধন অভিযানের তৃতীয় দিনে এডিস মশার লার্ভা পাওয়ায় ১৬টি মামলায় ২৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মশক নিধন অভিযানে ২৩টি স্থাপনাকে ২ লাখ ১৩ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

দেশের ৬০ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু রোগী। আমাদের হিলি (দিনাজপুর) প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরের হিলিতে ঢাকা থেকে ঈদ করতে আসা দুজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে একজনকে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, গত চার দিনে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে সাতজন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। ঈদের পর থেকে এ জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আক্রান্ত ব্যক্তিরা স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও নিজ নিজ বাড়িতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে জানিয়েছেন কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. তাপস কুমার সরকার।
পিরোজপুর প্রতিনিধি জানান, পিরোজপুরে ২১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে নেছারাবাদ উপজেলায় আক্রান্ত হয়েছে ১০ জন। এসব রোগী জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট জানান, সিলেট মহানগর ও জেলায় এ বছর ৯২ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। গত কয়েকদিনে আক্রান্তের সংখ্যা আগের তুলনায় বাড়ছে। বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১৭ জন।

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল জানান, শেরেবাংলা মেডিকেলে গতকাল ৭৭ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত শনিবার চিকিৎসাধীন ছিলেন চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ সংখ্যক ৮৪ জন রোগী। হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচ এম সাইফুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে