অ্যান্টিবায়োটিক, জীবনদায়ী ওষুধ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। মূলত এটি এক ধরনের অণুজীবনাশী পদার্থ; যা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের বিরুদ্ধে কাজ করে। কিন্তু চিকিৎসক ও রোগী- উভয়ের অসচেতনতা, অবহেলা ও অজ্ঞতার কারণে বাংলাদেশে ক্রমশ তা কার্যকারিতা হারাচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি এখন শিশুদের শরীরেও অকার্যকর হয়ে পড়ছে। দুটি আলাদা গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা ৯ ভাগ শিশুর মধ্যে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। ৭০ শতাংশ নিউমোনিয়া রোগীর শরীরে কার্যকারিতা হারিয়েছে চার ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক। কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না, এমন রোগীর সংখ্যা ৭ শতাংশ।
বাংলাদেশের অ্যান্টিবায়োটিক পরিস্থিতি নিয়ে পরিচালিত এসব গবেষণা সম্প্রতি ‘প্লাস ওয়ান’ নামে একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত অপ্রয়োজনীয় ও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সেবনের কারণে কার্যকারিতা হারাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। করোনাকালে এই সমস্যা বেড়েছে আরও আশঙ্কাজনক হারে। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা সংক্রমিত রোগীদের ৮০ শতাংশকে প্রয়োজন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, দেশে প্রায় আড়াই লাখের মতো ওষুধের দোকান আছে। এর মধ্যে এক লাখ বা তারও বেশি অননুমোদিত। এসব দোকান মালিক চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই ওষুধ বিক্রি করে। শহরের দরিদ্র বস্তি অঞ্চল, নিম্ন আয়ের মানুষ এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই এসব ওষুধের দোকানের ক্রেতা। প্রতিদিন জ্বর, সর্দি, কাশি, শরীর ব্যথা, আমাশয় আক্রান্ত কয়েক লাখ মানুষ ওষুধের দোকানদার, অপ্রশিক্ষিত ব্যক্তির পরামর্শে অথবা নিজের ইচ্ছায় অ্যান্টিবায়োটিক কিনে সেবন করেন। বেশির ভাগই ব্যবহারে কোনো নীতিমালা মানেন না। অনেকে ফুল কোর্স ওষুধও সেবন করেন না। এভাবে অনিরাপদ ব্যবহার অ্যান্টিবায়োটিককে অকার্যকর করে তুলছে। এতে করে ভবিষ্যতে কেউই নিরাপদ থাকবে না। হয়তো এমন অবস্থা হতে পারে যেখানে সেলফ ভর্তি অ্যান্টিবায়োটিক থাকবে কিন্তু কোনো কার্যকারিতা থাকবে না।
তিনি বলেন, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের উন্নত অনেক দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কমিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কমানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এ অঞ্চলে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা হারাচ্ছে।
বয়স্ক ও শিশুদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা হারানোর বিষয়টিকে অশনিসংকেত বলে মনে করেন গবেষকরা। এ সংক্রান্ত গবেষণার সঙ্গে যুক্ত চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. নাহিদ সুলতানা বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে শরীরে সেই ওষুধের প্রতি রেজিস্ট্যান্স বা প্রতিরোধ তৈরি হয়। তখন সেই ওষুধ আর কাজ করতে চায় না। কারণ শরীরে থাকা ব্যাকটেরিয়া তখন ওষুধের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
তিনি বলেন, ব্যাকটেরিয়াজনিত কিছু রোগের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক অপরিহার্য। কিন্তু আগে থেকে এটি কার্যকারিতা হারালে মৃত্যু ছাড়া তখন কোনো গতি থাকবে না।
অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা নিয়ে আইইডিসিআরের এক গবেষণায় দেখা যায়, অ্যামিকাসিন নামের একটি অ্যান্টিবায়োটিক ২০১৭ সালে ২৬ শতাংশ ক্ষেত্রে অকার্যকর ছিল। ২০২১ সালে তা বেড়ে ৩৩ শতাংশ হয়েছে। অ্যাম্পিসিলিন ২০১৭ সালে ৭৩ শতাংশ ক্ষেত্রে অকার্যকর ছিল। এখন তা ৮৬ শতাংশ।
কভিড-১৯ রোগী ভর্তি হওয়া ঢাকার তিনটি হাসপাতালে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে আইইডিসিআর। এতে দেখা যায়, কোনো ধরনের প্রয়োজন ছাড়াই ৮০ শতাংশ রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে। আর আইসিইউতে ভর্তি রোগীর ৮০ থেকে ১০০ শতাংশকে এই ওষুধ দেওয়া হয়েছে। আবার ভর্তি হওয়ার আগেই ৩৩ শতাংশ রোগী নিজেই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করে হাসপাতালে এসেছেন। মৃদু বা মাঝারি উপসর্গ থাকা অনেকেই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করেছেন।
মহামারিকালে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ে বৈশ্বিক গবেষণার তথ্য তুলে ধরে আইইডিসিআরের গবেষকরা বলেন, মাত্র ৬ দশমিক ৯ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন ছিল।
চট্টগ্রামের একদল গবেষক সম্প্রতি ২০ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা যাচাই করেন। এতে দেখা গেছে, সেফুরোক্সিম, সেফিক্সিম, সেফোট্যাক্সিম ও সেফটাজিডাইম জেনেরিকের আওতায় অ্যান্টিবায়োটিক রোগীর শরীরে কাজ করেছে খুবই কম। প্রমাণ মিলেছে সেফুরোক্সিম, সেফিক্সিম, সেফোট্যাক্সিম, সেফটাজিডাইম, সেফেপাইম ও সেফট্রিয়াক্সোন যথাক্রমে ৭৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ, ৭৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ, ৭৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ, ৭৪ দশমিক ২৫ শতাংশ, ৬৮ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং ৬৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে অকার্যকর। একাধিক জিন অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে ৬০ ভাগ ক্ষেত্রেই এনডিএম-১ নামের এক জিনের উপস্থিতি দেখা গেছে। ৪০ ভাগ ক্ষেত্রে পাওয়া গেছে এসএইচভি-১১ নামের অপর এক জিনের উপস্থিতি। আর ইউজিই জিনের বিস্তার দেখা গেছে ৩০ ভাগ ক্ষেত্রে।
ওই গবেষণায় আর দেখা যায়, বেশির ভাগ রোগীই অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী বিভিন্ন সংক্রমণে আক্রান্ত হচ্ছেন হাসপাতালের বেসিন, অপরিচ্ছন্ন খাবার, নালার পানি, হাসপাতালের চাদর কিংবা অপরিচ্ছন্ন দেয়াল থেকে।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই কিছু মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছেন। কেউ কেউ ফুল কোর্স সেবন না করে মাঝপথে বন্ধ করে দিচ্ছেন। আবার কেউবা অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছেন মাত্রাতিরিক্ত। ওষুধের দোকানদার এজন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী। তবে চিকিৎসকরাও কম দায়ী নন। এসব কারণে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারাচ্ছে।