বাইরের রোগীর চাপ রাজধানীতে

0
810

বিভিন্ন মফস্বলের করোনা রোগীদের চাপ রাজধানীতে বাড়ছে। সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে সরকার এপ্রিলে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের পর মে মাসে দৈনিক শনাক্ত মৃত্যুর সংখ্যা বেশ খানিকটা কমে এসেছিল।

কিন্তু করোনা ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ডেলটার কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ঘটায় রাজধানীর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংক্রমণ ও মৃত্যু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আবার বাড়ছে।

রাজধানীতে ২ কোটি মানুষের বসবাস। প্রতিদিন সংক্রমিত জেলা থেকেও করোনা রোগীরা রাজধানীতে আসছেন। এর মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ ভাগের আইসিইউ প্রয়োজন হচ্ছে। ইতিমধ্যে রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতালের আইসিইউ রোগীতে পূর্ণ হয়ে গেছে। রাজধানীতেও সংক্রমণ বাড়ছে।

এ অবস্থায় রাজধানীর চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, রাজধানী মূলত অরক্ষিত অবস্থায় আছে। জেলা পর্যায় থেকে মানুষ রাজধানীতে যাতায়াত অব্যাহত রেখেছেন। যে কারণে সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে ছড়িয়েছে অধিক সংক্রমিত করোনার ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট। রাজধানীর চারপাশে করোনার সংক্রমণ ব্যাপক হারে বাড়ছে। মাঝখানে রাজধানী। এ অবস্থায় সবাই স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চললে করোনা সংক্রমণ সর্বোচ্চ চূড়ায় যাবে। তখন চিকিৎসাসেবা ভেঙে পড়বে।

রাজধানীর হাসপাতালে সিট পেতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হবে। এদিকে রাজধানীকে সুরক্ষিত রাখতে কোরবানির পশুর হাট বন্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছিল করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি। কিন্তু সেই পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে গণহারে টিকা দিতে হবে। কিন্তু যেহেতু টিকার সংকট, তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমার জীবন আমাকে রক্ষা করতে হবে। সবার স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। আর পশুর হাটে যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলা হয়, তাহলে সামনে ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হবে। কারণ বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ রাজধানীর পশুর হাটে আসবে, তারা সংক্রমিত হয়ে আবার গ্রামে গিয়ে সেখানে সংক্রমণ ছড়াবে। চিকিৎসাসেবা পাওয়া কঠিন হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য ২০টি আইসিইউ শয্যা আছে। সব কয়টি বেডেই রোগী ভর্তি আছে।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্টের সভাপতি বিএসএমএমইউর অ্যানেসথেসিয়া, এনালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, বিভিন্ন জেলা থেকে করোনা রোগী রাজধানীতে চিকিৎসাসেবার জন্য আসছেন। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ডাক্তাররাও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেক চিকিকসক টিকা নেওয়ার কারণে পিপিই ব্যবহার করেন না। এতে ঐ চিকিৎসক তার পরিবারের সদস্যদের সংক্রমিত করছে। অনেক ডাক্তারের মা-বাবা করোনা আক্রান্ত হয়েছেন।

তিনি বলেন, বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি খারাপ দিকে যাওয়ার কারণ আক্রান্তদের বেশির ভাগই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত। তাই এখন এলাকাভিত্তিক চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারলে ঢাকাকে রক্ষা করা কঠিন হবে। কিন্তু এলাকাভিত্তিক চিকিত্সাব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার বিভিন্ন এলাকায় হাসপাতালে এক পাশে করোনা রোগী, অন্য পাশে অন্যান্য রোগী। এতে সংক্রমণ বাড়ছে। ঢাকার বাইরে করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবায় চরম অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। এতে বাইরে থেকে রোগীরা ঢাকায় আসছে। আর ঢাকা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাই ঢাকাকে রক্ষা করা খুবই কঠিন।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খলিলুর রহমান বলেন, তার হাসপাতালে প্রতিদিনই করোনা বাড়ছে।

ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, এ হাসপাতালের আইসিইউতে বর্তমানে ৮২ জন করোনা রোগী ভর্তি আছেন। গত চার দিনের প্রতিদিনই ৫০ জন করোনা রোগী ভর্তির জন্য আসছেন। এর মধ্যে প্রতিদিন ৩০ জনকে আইসিইউতে ভর্তি করা হচ্ছে। বাকি ২০ জনকে বাসায় কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়। করোনা রোগীদের জন্য দেশের সর্ববৃহৎ এই হাসপাতালে ৫০০ শয্যা আছে। এর মধ্যে ২০০ বেডে রোগী চিকিত্সাধীন। রোগীর চাপ বাড়লে বেড আরো বাড়ানো হবে।

সোসাইটি অব মেডিসিনের মহাসচিব ও মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, এদেশে অবস্থানরত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকরাও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। গতকাল রাশিয়ার চার জন আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের এ জেড এম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

তিনি বলেন, করোনা ঝুঁকির দিক থেকে ঢাকা অরক্ষিত। এটাকে রক্ষা করা সম্ভব না। নদীর বাঁধ যেমন বালি দিয়ে ঠেকানো যায় না, তেমনি কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়া করোনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। কেউ লকডাউন মানে না, স্বাস্থ্যবিধি মানে না। এ অবস্থায় দেশে করোনার ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট যেভাবে ছড়াচ্ছে তাতে আল্লাহ আল্লাহ করা ছাড়া উপায় নেই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রোভিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন বলেন, রাজধানী মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে। এটাকে রক্ষা করা কঠিন হবে। সামনে কোরবানির পশুর হাটের শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করা না গেলে করোনার ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হবে। তখন চিকিৎসাসেবা পাওয়া কঠিন হবে।

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। শুধু লকডাউন ঘোষণা দিয়ে ঢাকার সংক্রমণ রোধ করা কঠিন হবে। ব্যক্তিগত সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানাতে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। না হলে সামনে ব্যাপক হারে মানুষ সংক্রমিত হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে