সাত মাসেও হয়নি ক্ষতিপূরণের জন্য মৃত স্বাস্থ্যকর্মীদের তালিকা

0
853
Spread the love

করোনাভাইরাসে মারা গেছেন ১১৫ স্বাস্থ্যকর্মী

দেশে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১০৩ জন চিকিৎসক ও ১২ জন নার্স। এর মধ্যে সরকার-ঘোষিত ক্ষতিপূরণের অর্থ পেয়েছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। সরকারের ঘোষণার সাত মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া চিকিৎসকসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের তালিকা তৈরি করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদফতর।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত কভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ৩২ জন সরকারি কর্মকর্তা ক্ষতিপূরণের অর্থ পেয়েছেন। এর মধ্যে দুজন সচিব, ২৯ জন পুলিশ ও একজন চিকিৎসক রয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, অর্থ মন্ত্রণালয়ে ক্ষতিপূরণের তালিকা এলে ক্ষতিপূরণ পেতে বেশি সময় লাগে না। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখনো তালিকা পাঠায়নি। এখন পর্যন্ত শুধু ক্ষতিপূরণের ৫০ লাখ টাকা পেয়েছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া প্রথম চিকিৎসক ডা. মঈন উদ্দিনের পরিবার।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদফতরের কাছে কভিডে মারা যাওয়া চিকিৎসকদের তালিকা ছিল না। এক মাস আগে আমরা স্বাস্থ্য অধিদফতরকে কভিডে মারা যাওয়া চিকিৎসকদের তালিকা পাঠিয়েছি।’

২৩ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কোনো সরকারি কর্মকর্তা মারা গেলে ২৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা পাবেন। আর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে পাবেন ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা। মাঠপর্যায়ে কর্মরত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ যে-কেউ সরকারি নির্দেশনা পালন করতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হলে বা মারা গেলে গ্রেড ভেদে এ টাকা পাবেন।

গ্রেড ভেদে ক্ষতিপূরণ উল্লেখ করে এতে বলা হয়েছে, প্রথম-নবম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে পাবেন ১০ লাখ টাকা। মারা গেলে পাবেন ৫০ লাখ। দশম থেকে ১৪তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে পাবেন সাড়ে ৭ লাখ টাকা। মারা গেলে পাবেন সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। ১৫তম থেকে ২০তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে পাঁচ লাখ আর মারা গেলে ক্ষতিপূরণ পাবেন ২৫ লাখ টাকা। ২০১৫-এর বেতন স্কেল অনুযায়ী এ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এই অর্থ দেওয়া হবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ করা করোনা সংক্রান্ত স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় ক্ষতিপূরণ খাত থেকে। এ জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে। আর এ জন্য ৮০০ কোটি টাকা রাখা হচ্ছে ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে।

ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমরা চিকিৎসকেরা কোনো প্রণোদনা চাইনি। আমরা শুধু প্রটেকশন ও থাকার জায়গা চেয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী নিজেই ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছেন। তাই আমরা মনে করি, ক্ষতিপূরণের টাকা দ্রুত পেলে চিকিৎসকদের কাজে মনোবল বাড়ত। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু নির্দেশ দিয়েছেন তাই আমরা আশা করছি মৃত চিকিৎসকদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাবে।’

বিএমএর তথ্যানুযায়ী, ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৮ হাজার ৯২ জন স্বাস্থ্যকর্মী। এর মধ্যে চিকিৎসক ২ হাজার ৮৫৩ জন, নার্স ১ হাজার ৯৬৮ ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ৩ হাজার ২৭১ জন। এদের মধ্যে ১০৩ জন চিকিৎসক ও ১২ জন নার্স মারা গেছেন।

বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইসমত আরা পারভীন বলেন, ‘একজন চিকিৎসক ক্ষতিপূরণ পেলেও এখন পর্যন্ত একজন নার্সও ক্ষতিপূরণের অর্থ পাননি। এমনকি কভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া নার্সরা প্রতিদিন খাবার ভাতাও পাচ্ছেন না।’ ৯ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা এক পরিপত্রে বলা হয়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা প্রদানে সরাসরি কর্মরত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এককালীন দুই মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পাবেন। তবে এখন পর্যন্ত কোনো স্বাস্থ্যকর্মী সেই অর্থ পাননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালের কভিড-১৯ আইসিইউতে চিকিৎসা দেওয়া এক চিকিৎসক বলেন, ‘জুন মাসে কভিড-১৯ নেগেটিভ হওয়ার পর হাসপাতাল থেকে করা তালিকায় আমার নাম ভুক্ত করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো টাকা পাইনি। এমনকি প্রণোদনার দুই মাসের বেসিক বেতনেরও টাকাও পাইনি।’ ওই চিকিৎসক বলেন, ‘আমরা সরকারি কর্মচারী। প্রণোদনা না দিলেও এমনিতেই আমরা দায়িত্ব পালন করব। কিন্তু প্রণোদনার কথা বলে সেটি না দেওয়ায় নিজেদের প্রতারিত মনে হয়। কারণ পুলিশ, ব্যাংকারসহ অন্য পেশাজীবীরা প্রণোদনার টাকা পেয়েছেন। যেসব চিকিৎসক মারা গেছেন তাদের সবার পরিবার টাকা না পেলেও কয়েকজন যদি কিছু অর্থ পেতেন, তাহলেও আমরা ভরসা পেতাম। আমাদের কিছু হলে পরিবার সরকারের সহায়তা পাবে তা নিশ্চিত হতে পারতাম।

’ ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘কভিড-১৯ রোগীদের সরাসরি চিকিৎসা দেওয়া স্বাস্থ্যকর্মীদের দুই মাসের মূল বেতন দেওয়ার ঘোষণা দিলেও এখনো দেওয়া হয়নি। স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য অর্থ ব্যয় কোনোভাবেই অপচয় নয়। তারা কভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা করছেন। এরা ঝিমিয়ে পড়লে চিকিৎসায় প্রভাব পড়বে। কিন্তু মন্ত্রণালয় বিষয়টি বুঝতে পারছে না সেটি দুঃখজনক।’ স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) ডিরেক্টর ডা. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘কভিড-১৯ পজিটিভ হয়ে যেসব চিকিৎসক মারা গেছেন, তাদের তালিকা আমরা যাচাই-বাছাই করছি। আমাদের যাচাই-বাছাই শেষে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রশাসন বিভাগে পাঠানো হবে। সেখান থেকে তালিকা পাঠানো হবে মন্ত্রণালয়ে। কাজ চলছে। কিছুটা সময় লাগলেও চিকিৎসকেরা ক্ষতিপূরণ পাবেন।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে