আগস্টের ৭ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত দেশে ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে গণটিকা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। তবে অপরিকল্পিত এই কমূর্সচিতে দেশে মডার্নার টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। প্রথম ডোজ যারা নিয়েছেন, তাদের জন্য দ্বিতীয় ডোজের সংকট দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও হাজারো মানুষকে টিকা ছাড়া বাড়ি ফিরতে হয়েছে।
অন্যদিকে আবার কবে মডার্নার টিকা পাওয়া যাবে, সেটিও অনিশ্চিত। দেশে নিয়মিত আসছে চীনের সিনোফার্মের টিকা। তবে মিক্স ডোজ (দুই প্রযুক্তির দুই ডোজ টিকা) দেওয়ার সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। ফলে টিকা নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারত থেকে পাওয়া কোভিশিল্ডের টিকা প্রয়োগ নিয়ে শুরুতেই বাংলাদেশকে হোঁচট খেতে হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এক মাসে এক কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার ঘোষণার পর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এক সপ্তাহে এক কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানান। পরে সেটিও পরিবর্তন করে ৭ আগস্ট থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে গণটিকা কর্মসূচির আওতায় ১ কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার ঘোষণা দেন। এর পর আবারও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক সপ্তাহের পরিবর্তে মাত্র একদিন এ কর্মসূচি চলবে বলে জানায়।
সর্বশেষ ৬ দিনে ৩২ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। টিকা প্রদানে সর্বনিম্ন ১৮ বছর বয়সসীমা থেকেও পিছিয়ে ২৫ বছর করা হয়। মূলত সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জটিলতায় টিকাকেন্দ্রে বিশৃঙ্খল পরিস্থি সৃষ্টি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, টিকাদানের শুরুতে স্বাস্থ্য ও সরকারের অন্যান্য বিভাগ থেকে যেভাবে প্রচার চালানোর দরকার ছিল, তা যথেষ্ট হয়নি। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী সাধারণ মানুষ গণটিকা পেতে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে গেলেও টিকা দেওয়া হয়নি। টিকার নিয়ন্ত্রণ পেতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন স্থানে টোকেন পদ্ধতির প্রবর্তন করেছেন। বয়স্ক ও অসুস্থদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হলেও অনেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
এ ছাড়া টিকাকেন্দ্রের দীর্ঘ সারিতে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে কর্তৃপক্ষের তেমন উদ্যোগও দেখা যায়নি। ক্ষমতাসীন দের কাউকে নিজ কার্যালয়ে, বাসায় অথবা এক কেন্দ্রে নিবন্ধন করে অন্য কেন্দ্রে গিয়েও টিকা নিতে দেখা গেছে। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত টিকা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও সংকটের দোহাই দিয়ে দুপুরের মধ্যে টিকা শেষ হয়েছে বলে সাধারণ মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এমনকি টিকার জন্য আগের দিন রাত থেকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার পরের দিনও টিকা নিতে পারেননি। কেন্দ্রসংশ্লিষ্টরা বলেন, টিকা পেতে ইচ্ছুক মানুষের সংখ্যার চেয়ে সরবরাহ কম হওয়ায় সবাইকে টিকা দেওয়া যায়নি। কেন্দ্রে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে টিকাগ্রহীতাদের উদাসীনতা ছিল লক্ষণীয়।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সম্প্রসারিত কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল মূলত দুটি। প্রথমত অল্প সময়ে বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া। দ্বিতীয়ত তুলনামূলকভাবে গ্রামের যেসব মানুষের টিকা নেওয়ার প্রয়োজন বেশি, তাদের টিকা দেওয়া। প্রাথমিকভাবে সেই উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, সম্প্রসারিত কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার ইউনিয়ন/ওয়ার্ড পর্যায়ে যে টিকাদান কর্মসূচি নিয়েছে, তা অব্যাহত রাখা দরকার। টিকাদান ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে হবে। মানুষের মধ্যে টিকা গ্রহণের যে আগ্রহ দেখা দিয়েছে, এটি সরকারকে ধরে রাখতে হবে।
কোথাও কেউ যেন টিকা নিতে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে ফেরত না যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। অবশ্য টিকা প্রাপ্তির ওপর আমাদের এই কর্মসূচিটা সরকার কমাতে-বাড়াতে পারবে। তবে মানুষকে টিকাদানের সঠিক তথ্যটা জানাতে হবে। অনেকেই রেজিস্ট্রেশন করেছেন; কিন্তু বার্তা পাচ্ছেন না, তিনি কবে টিকা নেবেন। এমনটি করা যাবে না। মানুষ ধৈর্যচ্যূত হবে। সরকারকে বলতে হবে ষাট বছর বয়সীদের অমুক মাসে, পঞ্চাশ বছর বয়সীদের, চল্লিশ বছর বয়সীদের, ত্রিশ বছর বয়সীদের- এভাবে তথ্যটা জানা থাকলে মানুষ অপেক্ষা করবে এবং নিশ্চিত হবে ওমুক মাসে টিকা নিতে পারবে।
অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বৃহস্পতিবার করোনা টিকার সম্প্রসারিত কর্মসূচি শেষ হয়েছে। কর্মসূচির ছয় দিনে ৫৫ লাখ ৬৬ হাজারের বেশি মানুষ টিকা পেয়েছে। ৭ আগস্ট থেকে দেশব্যাপী করোনা টিকার সম্প্রসারিত কর্মসূচি শুরু করে স্বাস্থ্য বিভাগ। ছয় দিনে নিয়মিত করোনা টিকাকেন্দ্রের বাইরে ৪ হাজার ৬০০ ইউনিয়ন, ১ হাজার ৫৪টি পৌরসভার ওয়ার্ড এবং ১২টি সিটি করপোরেশনের ৪৩৩টি ওয়ার্ডে টিকাকেন্দ্রে করোনার টিকা দেওয়া হয়। এ ছাড়া কক্সবাজার জেলার শিবিরে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গাকে এ সময় টিকা দেওয়া হয়েছে।
আইসিটি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, গতকাল সন্ধ্যার পর নিবন্ধন করা মানুষের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ১৫ লাখ। এর মধ্যে ১ কোটি ৫৩ লাখের কিছু বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। টিকা পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন ১ কোটি ৬২ লাখ মানুষ।
সম্প্রসারিত কর্মসূচির ফলে অল্প সময়ে বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে ঠিকই, তবে এই সময়ে নিবন্ধন করে টিকার অপেক্ষায় থাকা মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে এখন টিকা আছে ৮২ লাখের বেশি। গতকাল স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আগামী এক সপ্তাহে ৫৪ লাখ টিকা আসবে। এ মাসের শেষ নাগাদ আসবে আরও প্রায় ৫০ লাখ টিকা।
অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশে চার ধরনের টিকার (অক্সফোর্ড, ফাইজার, মডার্না এবং সিনোফার্ম) এ পর্যন্ত প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে এক কোটি ৫৩ লাখ ১১ হাজার ৬৬৯ জনকে। দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৫২ লাখ ২৪ হাজার ৩১১ জন।
এমন পরিস্থিতিতে করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষায় টিকার তৃতীয় ডোজ প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য এবং ওষুধ প্রশাসন সংস্থা (এফডিএ)। বৃহস্পতিবার এই অনুমোদন দেওয়া হয়। ফাইজার ও বায়োএনটেক এবং মডার্নার তৈরি টিকার তৃতীয় ডোজের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যেসব মার্কিন নাগরিকের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা দুর্বল তাদের শুধু এই ডোজ দেওয়া হবে।
দেশে এখন চার কোম্পানির কোভিড-১৯ টিকা দেওয়া হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে- অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না ও সিনোফার্মের টিকা। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিভিন্ন উৎস থেকে এসব কোম্পানির মোট দুই কোটি ৯০ লাখ ৪৩ হাজার ৯২০ ডোজ টিকা এসেছে।
এর মধ্যে রয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার এক কোটি ১৯ লাখ ৪৩ হাজার ৩০০, মডার্নার ৫৫ লাখ, সিনোফার্মের ১ কোটি ১৫ লাখ ডোজ এবং ফাইজারের এক লাখ ৬২০ ডোজ টিকা। এ পর্যন্ত দুই কোটি ৫৩ লাখের কিছু বেশি ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। আর মজুদ আছে প্রায় ৪০ লাখের মতো।
এমন পরিস্থিতিতে গতকাল শুক্রবার সন্ধায় দেশে আরও ১০ লাখ সিনোফার্মের টিকা এসেছে। চীন থেকে উপহারের করোনার টিকা নিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট ঢাকায় এসেছে।
গত ১২ মে বাংলাদেশকে ৫ লাখ টিকা উপহার দেয় চীন। ১৩ জুন চীনের দ্বিতীয় দফা উপহারের ৬ লাখ টিকা আসে। গতকাল শুক্রবার তৃতীয় দফায় আসে চীনা উপহারের ১০ লাখ টিকা। এ নিয়ে চীন সরাসরি উপহার হিসেবে বাংলাদেশকে ২১ লাখ টিকা দিল। এ ছাড়া টিকার বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্সের আওতায় দুই দিনে ৩৪ লাখ ৭০ হাজার সিনোফার্মের টিকা বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে চীন। কোভ্যাক্সের আওতায় এর আগে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে মডার্নার এবং জাপান অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পাঠিয়েছে। আর কোভ্যাক্স সরাসরি পাঠিয়েছে ফাইজারের টিকা। তবে মডার্নার বা ফাইজারের টিকা পরবর্তীতে কবে আসবে- এমন তথ্য নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে।