মেডিসিন সোসাইটির সভাপতি-
দেশে হঠাৎ করেই ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণের বিষয়টি বড় হয়ে উঠেছে। এই ছত্রাকের সংক্রমণে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে একজন মারা গেছেন ও অন্য দুজন আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন—চিকিৎসকরা এমন সন্দেহ প্রকাশ করার পর বিষয়টি নিয়ে সব মহলে আলোচনা চলছে। বিশেষ করে ভারতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস নিয়ে ব্যাপক আতঙ্কের কারণে বাংলাদেশেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও। পাশাপাশি এ বিষয়ে সরকারও সতর্ক রয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে ভারতে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে ফাঙ্গাস সংক্রমণজনিত যে জটিলতা এবং এরই মধ্যে অন্তত দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হচ্ছে, সেটা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস নয় বলে সে দেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন। তাঁরা বলছেন, সেখানে করোনা রোগীদের মধ্যে যে ফাঙ্গাসজনিত মিউকোরমাইকোসিস রোগের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে সেটা আর ব্ল্যাক ফাঙ্গাস এক নয়। ভারতের স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. বিভূতি সাহা আনন্দবাজার ডিজিটালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সে কথাই বলেছেন।
বাংলাদেশে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণজনিত রোগের সঙ্গে করোনাভাইরাসের সরাসরি কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এই রোগটি অনেক পুরনো এবং যে কেউ এতে আক্রান্ত হতে পারে। তবে আগে থেকে ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে আক্রান্তদের মধ্যে যারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকেন তাঁরা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হলে পরস্থিতি আরো খারাপ হয়। ফলে তাঁদের জন্য এ রোগের ব্যাপারে সতর্কতা জরুরি।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা মেডিক্যালে এক অনুষ্ঠানে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, আগাম সতর্কতা হিসেবে দেশের বিভিন্ন ওষুধ কম্পানিকে ব্ল্যাক ফ্যাঙ্গাসের ওষুধ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে বলা হয়েছে এবং একই সঙ্গে এই রোগের উপযুক্ত চিকিৎসায় করণীয় কী হবে সে ব্যাপারেও সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির সভাপতি ও মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর কালের কণ্ঠকে বলেন, শুধু ব্ল্যাক ফাঙ্গাসই নয়, হোয়াইট ফাঙ্গাস ও ইয়োলো ফাঙ্গাসও আছে। এটা প্রকৃতিতে বিশেষ করে মাটিতে থাকে। মানুষ এর সঙ্গেই বসবাস করে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি তাদের এই ফাঙ্গাস কোনো ক্ষতি করতে পারে না। করোনার সঙ্গে এই রোগের সরাসরি কোনো সম্পৃক্তা নেই।
ওই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বলেন, আগে থেকেই যাঁরা মারাত্মক পর্যায়ের ডায়াবেটিস কিংবা অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত, তাঁরা করোনায় আক্রান্ত হলে এক পর্যায়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ওই সুযোগে এই ফাঙ্গাস ফুসফুসসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ক্ষতি করে। এ ক্ষেত্রে যাঁদের ডায়াবেটিস বা অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত হওয়া অবস্থায় স্টেরয়েড দেওয়া হয় তাঁদের সুগার বেড়ে যায় এবং আরো কিছু সমস্যা তৈরি করে, তখন এই ফাঙ্গাসগুলোর আক্রমণ জোরালো হয়।
বারডেমের যুগ্ম পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. নাজিমুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আমাদের একাডেমিক ও রিসার্চের অংশ হিসেবেই বিভিন্ন সন্দেহজনক রোগীর দিকে আলাদা নজর রাখি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকি। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই তিনজন রোগীকে আমরা মিউকোরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত বলে সন্দেহ করি। প্রাথমিক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তেমন কিছু লক্ষণও এসেছে। তবে এটি চূড়ান্ত বলা যাবে না। কারণ চূড়ান্ত বলতে হলে ব্লাডের কালচারের রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, যেই রিপোর্ট এখনো আমরা পাইনি। এ জন্য আরো চার-পাঁচ দিন অপেক্ষা করতে হবে।’
ওই কর্মকর্তা বলেন, যিঁনি মারা গেছেন তিনি ৬৯ বছরের একজন পুরুষ রোগী ছিলেন। এসেছিলেন ফরিদপুর থেকে। করোনাভাইরাস, মারাত্মক ডায়াবেটিস, কিডনি বিকল, উচ্চরক্তচাপসহ আরো কিছু জটিল রোগ ছিল তাঁর। খুবই খারাপ ছিল তাঁর অবস্থা। গবেষণার আওতায় তাঁরা ওই রোগীর দিকে বাড়তি নজর দেন এবং ফাঙ্গাস সংক্রমণ পরীক্ষার উদ্যোগ নেন। কিন্তু এর মধ্যেই ওই রোগী তিন দিন আগে মারা যান। ফলে তাঁরা আর নিশ্চিত হতে পারেননি। এখন যে নমুনা আছে সেগুলো থেকে যদি কিছু শনাক্ত হয় তবেই নিশ্চিত হওয়া যাবে, আর না হলে ওই রোগীকে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের রোগী বলা যাবে না। আরেকজন রোগী আসেন সাতক্ষীরা থেকে। তিনিও আগে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং পরবর্তী জটিলতা বেড়ে যায়। তাঁর প্রচণ্ড জ্বর, শ্বাসকষ্ট, নাক দিয়ে রক্ত পড়ার কারণে সন্দেহবশত তাঁর কিছু পরীক্ষা করেছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি। তাঁর বয়স ৫৩ বছর। অন্য রোগীটি আসেন ঢাকার ধামরাই থেকে। তাঁর বয়স ২৪ বছর। তাঁকেও সন্দেহবশত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কিছু লক্ষণ পাওয়া যায়। পরে তিনি নিজেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চলে যান। পরে বারডেমের চিকিৎসকরা শুনেছেন ওই রোগীর ব্ল্যাক ফাঙ্গাস শনাক্ত হয়নি।
ডা. নাজিমুল বলেন, ‘আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে শনাক্ত বা প্রমাণ না পাব ততক্ষণ এটা নিয়ে খুবই সতর্কভাবে তথ্য প্রকাশ করা উচিত, যাতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক না ছাড়ায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা করোনা মহামারির আগেও এ ধরনের ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের রোগী পেয়েছি।’
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, ‘বারডেমে দুজন রোগী ওই ফাঙ্গাসে আক্রান্ত বলে সন্দেহ করা হয়েছে। আমাদের গবেষকরা নমুনা সংগ্রহ করেছেন। সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিশ্চিত করে বলা যাবে।’