কোলন ক্যান্সার কী?
মানুষের পরিপাকতন্ত্রের সর্বশেষ ছয় ফুটের মতো দীর্ঘ অংশের নাম হচ্ছে বৃহদন্ত্র। আর এই বৃহদন্ত্রের ক্যান্সারকেই কোলন ক্যান্সার বলে। নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে সারা বিশ্বে যত মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে, তার মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ হচ্ছে কোলন ক্যান্সার, যদিও বাংলাদেশে এ রোগের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে সঠিক ডাটা নেই। তবে মনে করা হয়, প্রথম পাঁচটি প্রধান ক্যান্সারের অন্যতম এই কোলন ক্যান্সার।
লক্ষণ
♦ পায়ুপথে রক্তপাত।
♦ মলের সঙ্গে রক্ত যাওয়া।
♦ কোষ্ঠকাঠিন্যতা।
♦ পেট ব্যথা।
♦ ওজন কমে যাওয়া।
♦ পেটে চাকা অনুভব হওয়া।
রক্তশূন্যতা
হঅনেক সময় পেটের কোনো উপসর্গ ছাড়াই শুধু রক্তশূন্যতা নিয়ে কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী হাজির হতে পারে হাসপাতালে। তাই বয়স্ক কোনো নারী-পুরুষ যদি এনিমিয়া বা রক্তশূন্যতায় ভুগে থাকে, তবে তাকে শুধু শরীরে রক্ত ভরে চিকিৎসা দেওয়াই মূলকথা নয়। রক্তশূন্যতার অন্যান্য কারণের পাশাপাশি কোলন ক্যান্সারের পরীক্ষাও করা উচিত।
ওপরের লক্ষণগুলো কারো দেখা দিলে নিকটস্থ গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বা পরিপাকতন্ত্র রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।
কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কাদের বেশি?
♦ ৪৫ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে সব ব্যক্তি।
♦ যাদের অতি নিকটাত্মীয়ের (মা, বাবা, ভাই, বোন, ছেলে, মেয়ে) কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস আছে।
♦ আগে কোনো ব্যক্তি যদি নিজে কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
♦ ‘ক্রোনস ডিজিজ’ বা ‘আলসারেটিভ কোলাটিস’ নামক ‘ইনফ্লেমেটরি বাওয়েল ডিজিজে’ আক্রান্ত রোগী।
♦ ‘ফ্যামিলিয়াল অ্যাডিনোমেটাস পলিপোসিস সিনড্রোমে’ আক্রান্ত রোগী।
♦ ক্ষেত্রবিশেষে ব্রেস্ট ক্যান্সার ও সারভাইকেল ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যক্তি।
♦ গ্রোথ হরমোন আধিক্যের কারণে ‘অ্যাক্রোমেগালি’ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি।
কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়
♦ হঅতিরিক্ত রেড মিট বা লাল মাংস (গরু, খাসি) খাওয়া।
♦ হপ্রক্রিয়াজাত (যেমন—গরু, খাসি) মাংস খাওয়া।
♦ হধূমপান।
♦ হশারীরিক স্থূলতা।
♦ হনিয়মিত অতিরিক্ত মদ্যপান (প্রতিদিন ৩০ গ্রামের অধিক)।
কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়
♦ আঁশজাতীয় খাবার গ্রহণ।
♦ নিয়মিত ব্যায়াম করা।
♦ স্থূলতা নিয়ন্ত্রণ করা।
‘প্রি-ক্যান্সারাস পলিপ’ কী
কোলন অন্যান্য ক্যান্সারের মতো নয়। সাধারণত বেশির ভাগ কোলন ক্যান্সারই ‘অ্যাডিনোমেটাস’ এবং ‘সিরেটেড কোলনিক পলিপ’ থেকে কোলন ক্যান্সার হয়ে থাকে। মনে রাখতে হবে, সব রকম পলিপই কিন্তু কোলন ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয় না। কিন্তু সব কোলনিক ক্যান্সারই ‘কোলনিক পলিপ’ থেকে হয়ে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পলিপ থেকে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হতে প্রায় পাঁচ থেকে ১০ বছর লেগে যায়। পলিপ হচ্ছে ছত্রাকসদৃশ অথবা সমতল আকারের কোলনের দেয়ালের এক ধরনের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। পলিপ সাধারণত ধীরে ধীরে কয়েক বছরব্যাপী কোলনের গায়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সব রকমের পলিপের ক্যান্সারে রূপান্তরিত হওয়ার সমান ঝুঁকি থাকে না। শুধু প্রি-ক্যান্সারাস পলিপেরই (‘অ্যাডিনোমেটাস’ ও ‘সিরেটেড’) কোলন ক্যান্সারে রূপান্তরিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। অন্য সব পলিপের (‘হাইপারপ্লাস্টিক’ ও ‘ইনফ্লেমেটরি’ পলিপ) ক্যান্সারে রূপান্তরিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। স্ক্রিনিং এবং প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ই কার্যকরী চিকিৎসার চাবিকাঠি।
‘প্রি-ক্যান্সারাস পলিপ’ ক্যান্সারে রূপান্তরিত হওয়ার আগেই কোলনোস্কোপির মাধ্যমে কেটে ফেলে দিলে কোলন ক্যান্সারকে প্রতিহত করা যায়। অথবা ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়ে এবং ক্যান্সার রোগের উপসর্গ ও লক্ষণ প্রকাশের আগেই রোগটি ধরা পড়লে সার্জারির মাধ্যমে কোলন ক্যান্সারকে নির্মূল করা সম্ভব। কোলন ক্যান্সার কোলন থেকে শরীরের অন্য কোনো অংশে ছড়িয়ে পড়লে এর চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রেই দুরূহ হয়ে পড়ে। তাই ৪৫ বছরের ওপর বয়সীদের নিয়মিত কোলনোস্কোপি পরীক্ষার মাধ্যমে কোলন ক্যান্সার স্ক্রিনিং করা উচিত। কোলন ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণীত হলে এবং চিকিৎসা করালে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ রোগী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে।
কোনো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে এই বয়সের আগেও কোলন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে এবং তাদের বয়স ৪৫ হওয়ার আগেই স্ক্রিনিং কোলনোস্কোপি পরীক্ষা করানোর প্রয়োজন হতে পারে, বিশেষত কারো যদি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ইতিহাসে কোলন ক্যান্সার, কোলনিক পলিপ, ইনফ্লেমেটরি বাওয়েল ডিজিজ, ডিম্বাশয় বা এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার থাকে।
চিকিৎসা কী?
♦ হসার্জারি।
♦ হকেমোথেরাপি।
♦ হরেডিওথেরাপি।
কত বয়স পর্যন্ত কোলন ক্যান্সার স্ক্রিনিং করা উচিত?
৪৫ থেকে ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত সবাইকেই নিয়মিত বিরতিতে কোলনোস্কোপি পরীক্ষার মাধ্যমে কোলন ক্যান্সার স্ক্রিনিং করা উচিত। আর যদি কারো নিকটাত্মীয় (মা, বাবা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে) কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকে, তাহলে তাদের ৪০ বছর বয়স থেকে অথবা নিকটাত্মীয় যে বয়সে কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে, সেই বয়স থেকে ১০ বছর আগে, এই দুই বয়সের মাঝে যেটি কম হবে সেই বয়স থেকে কোলন ক্যান্সার স্ক্রিনিং শুরু করতে হবে।
কী কী উপায়ে কোলন ক্যান্সার স্ক্রিনিং করা হয়?
কোলন ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি থাকলেও ‘কোলনোস্কোপি’ই সর্বোত্তম এবং সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য।
কোলনোস্কোপি কোথায় করা হয়?
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগে সাধারণত এই পরীক্ষা করা হয়ে থাকে।
ডা. মুহাম্মদ সায়েদুল আরেফিন,
সহকারী অধ্যাপক, শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল