চিকিৎসাধীন ৮০% রোগীই টিকা ছাড়া

0
566

রাজধানীর একটি কভিড হাসপাতালে আইসিইউ বেড ১০টি। সব বেডেই রোগী ভর্তি। তাদের মধ্যে কতজন করোনাভাইরাসের টিকা নিয়েছে তা খুঁজে দেখতে গিয়ে ফলাফল আসে, আটজন টিকা নেয়নি বা নিতে পারেনি। দুজন নিয়েছে। যারা টিকা ছাড়া তাদের সবার অবস্থাই তুলনামূলক বেশি খারাপ। যারা টিকা নিয়েছে তাদের মধ্যে একজনের দ্রুত উন্নতি ঘটছে এবং আর একজন মারা গেছে। যিনি মারা গেছেন তিনি আগে থেকেই নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত ছিলেন।

এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীদের মধ্যে টিকা নেওয়া না নেওয়া এবং টিকার প্রভাব পর্যবেক্ষণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন চিকিৎসক বলেন, ‘সমীক্ষা শেষ না হলেও আমরা দেখছি, এখন যারা হাসপাতালে আসছে তাদের ৮০ শতাংশের বেশি টিকা নেয়নি। আবার যারা টিকা নিয়েও কভিডে আক্রান্ত হচ্ছে তাদের মধ্যে আগের বিভিন্ন জটিলতার কারণে ৫-২০ শতাংশের পর্যায়ক্রমে আইসিইউতে যেতে হয়। আর মৃত্যুহার ২ শতাংশেরও কম হবে।’

অন্যদিকে রাজধানীর মহাখালী ডিএনসিসি কভিড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা একটি সমীক্ষা চালিয়েছি। যার কাজ প্রায় শেষ। দুই-এক দিনের মধ্যেই ফলাফল পাওয়া যাবে। তাই ফলাফল প্রস্তুতের আগে তা প্রকাশ করা ঠিক নয়। তবে এটা নিশ্চিত আমাদের এখানে যারা ঢাকার বাইরে থেকে ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আসছে তাদের বেশির ভাগই টিকা নেয়নি। যারা মারা যাচ্ছে তাদের মধ্যে এই সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।’

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহম্মেদ প্রায় একই রকম তথ্য দিয়ে বলেন, ‘ক্রিটিক্যাল অবস্থায় যারা আসছে এবং যাদের লাইফ সাপোর্টে নিতে হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগ টিকা নেয়নি। আর যাদের টিকা নিয়েও হাসপাতালে আসতে হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই দ্রুত সেরে উঠছে। কারো কারো হয়তো আগে থেকে নানামুখী জটিলতা থাকার কারণে ফেরানো কঠিন হয়ে পড়ে।’

বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির মহাসচিব ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, ‘আমি একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কভিড রোগীদের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখেছি, ৮০ শতাংশই টিকা নেয়নি। বাকি ২০ শতাংশ টিকা নিয়েও আক্রান্ত হয়েছে এবং জটিলতায় পড়েছে। এ ক্ষেত্রে সবার মনে রাখতে হবে কোনো টিকাই এখন পর্যন্ত শতভাগ নিরাপত্তা দিচ্ছে না। ফলে একটা গ্যাপ থেকেই যাচ্ছে। তাই টিকা দেওয়ার পরও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, বিশেষ করে মাস্ক পরতেই হবে, যতক্ষণ না দেশের সবার টিকা নিশ্চিত করা যাবে।’

আহমেদুল কবীর আরো বলেন, ‘তার পরও জোর দিয়েই বলব, কম হোক বেশি হোক টিকায় যতটা নিরাপত্তা দিচ্ছে, সেটাও অনেক কিছু। তাই সবার টিকা নিতে হবে। যারা টিকা নিচ্ছে তারা করোনায় আক্রান্ত হলেও তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক কম, সেটার প্রমাণ তো পাওয়াই যাচ্ছে।’ এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতিনির্ধারকদের খেয়াল রাখতে হবে বিচ্ছিন্নভাবে টিকা কার্যক্রম চালালে প্রত্যাশিত সুফল নাও মিলতে পারে। একযোগে সমন্বিত প্রক্রিয়ায় টিকা দেওয়া গেলে ভালো সাফল্য আসবে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট—আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, আমেরিকার সর্বশেষ এক গবেষণার তথ্য অনুসারে টিকা নেওয়ার পর শুধু কভিডে আক্রান্ত হওয়ার কারণে আইসিইউতে যাওয়ার হার ২ শতাংশ। বড়জোর কোথাও কোথাও এটা ৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। অর্থাৎ যারা টিকা নিয়েছে তাদের গড়ে ৯৫ শতাংশ সুরক্ষা মিলছে—এটা নিশ্চিত। যদিও আইইডিসিআর এখনো এ ধরনের কোনো সমীক্ষা চালায়নি। ড. আলমগীর আরো বলেন, টিকা নেওয়ার পরও করোনায় আক্রান্ত হয়ে যাদের আইসিইউতে যেতে হচ্ছে, তাদের আগে থেকেই দুরারোগ্য কোনো না কোনো জটিল সমস্যা থাকে, যেখান থেকে রোগীকে ফেরানোর কোনো উপায় থাকে না।

হাসপাতালগুলোর তথ্য ও বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য থেকে পাওয়া চিত্র অনুসারে, যারা টিকা নেয়নি বা কোনো কারণে নিতে পারেনি, তারা করোনায় আক্রান্ত হলে টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। বিশেষজ্ঞরা এ কারণে দেশে কভিডের টিকা দেওয়ার কার্যক্রম দ্রুত আরো সম্প্রসারণ করে যারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ তাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। বয়স্কদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে বারবার।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, টিকা জোগানে মাঝে কিছুটা সমস্যা থাকলেও এখন তা কেটে গেছে। নিয়মিত টিকা আসতে শুরু করেছে এবং পরিকল্পিতভাবেই টিকা দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ ফ্রন্টলাইনারদের সন্তানদের জন্য ১৮ বছর বয়স হলেই টিকা পাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকার নিবন্ধনেরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে এত কিছুর পরও টিকা নিবন্ধন করার দুই-তিন সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও এখনো টিকা নেওয়ার তারিখের এসএমএস না পাওয়ার অভিযোগ দিন দিন বাড়ছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক গতকাল শনিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্বিঘ্ন রাখতে এবং বেশির ভাগ নাগরিককে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসতে এখন থেকে পর্যায়ক্রমে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সব নাগরিককেই ভ্যাকসিন প্রদান করা হবে। এরই মধ্যে সরকারের আইসিটি বিভাগের আওতাধীন জাতীয় সুরক্ষা অ্যাপে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বের শিক্ষার্থী ও ফ্রনলাইনারদের সন্তানরা যাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রেজিস্ট্রেশন করতে পারে সে ব্যাপারে একটি নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, বর্তমানে সরকারের হাতে এক কোটির ওপরে টিকা আছে। আগামী মাসের মধ্যেই আরো দুই কোটি টিকা সরকারের হাতে চলে আসবে। এভাবে চীন থেকে তিন কোটি, রাশিয়া থেকে সাত কোটি, জনসন অ্যান্ড জনসনের সাত কোটি ভ্যাকসিন, অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি টিকাসহ আগামী বছরের শুরুর দিকেই সরকারের হাতে প্রায় ২১ কোটি টিকা চলে আসবে। আশা করা যাচ্ছে, এর মাধ্যমে দেশের অন্তত ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে সক্ষম হবে সরকার।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (ইপিআই) ডা. শামসুল হক বলেন, ‘আজ (গতকাল) অ্যাস্ট্রাজেনেকার যে টিকা এসেছে সেগুলো দিয়ে চলতি সপ্তাহের মধ্যেই দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে যাবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের একটি বড় পরিকল্পনা চলছে, শিশুদের ইপিআই টিকার আদলে এলাকায় এলাকায় ক্যাম্পেইন আকারে মানুষের বাড়ির কাছে গিয়ে ডেকে ডেকে টিকা দিয়ে দেওয়া। এ ক্ষেত্রে নিবন্ধনপ্রক্রিয়া অনেক সহজ করা হবে। যদিও এই পরিকল্পনা এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। আশা করা যায় দ্রুত সময়ের মধ্যেই সিদ্ধান্ত হবে। এ দফায় নিবন্ধন করেও অনেকের এসএমএস না পাওয়ার বিষয়ে এই পরিচালক বলেন, ‘কিছুটা সমস্যা হচ্ছে—এটা ঠিক। আমরা এই জটিলতা কাটানোর চেষ্টা করছি।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে