জরুরী ওষুধের দ্বিগুণ দাম

0
338
Spread the love

দেশে এমন কোন পরিবার হয়ত নেই যে পরিবারের শিশুদের জ্বর-সর্দিতে নাপা সিরাপ খাওয়ানো হয় না। চিকিৎসকরাও কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না থাকায় ধনী-গরিব নির্বিশেষে সব ধরনের শিশু রোগীর অভিভাবককেই এটি খাওয়ানোর পরামর্শ দেন। যারা একটু বিত্তশালী তাদের কোন সমস্যা না হলেও সম্প্রতি সিরাপটির প্রায় দ্বিগুণ দামে দিশেহারা নিম্নবিত্ত মানুষ। ২০ টাকার নাপা সিরাপ বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। যা একেবারেই অস্বাভাবিক বলে দাবি সাধারণ মানুষের।

একই সঙ্গে গ্যাস্ট্রিকের চিকিৎসায় ব্যবহৃত জনপ্রিয় ক্যাপসুল সেকলোর দাম পাতা প্রতি বেড়েছে ২০ টাকা। উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় ব্যবহৃত এনজিলক ট্যাবলেটটির দাম আগে ৮ টাকা থাকলেও বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকায়। জরুরী চিকিৎসায় ব্যবহৃত এমন প্রায় সব ওষুধের দামই বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। মোট ১ হাজার ৬৫০টি জেনেরিকের মধ্যে সরকার নিয়ন্ত্রিত ১১৭টা ওষুধের মধ্যে সম্প্রতি ৫৩টি ওষুধের বাড়ানো হলেও বাজার ঘুরে দেখা যায় প্রায় সব ওষুধেরই দাম বেড়েছে আকাশছোঁয়া। আর এর কারণ হিসেবে ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে সাম্প্রতিক ডলারের উর্ধমুখী প্রবণতাকে দুষছেন ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিনে রাজধানীর কয়েকটি এলাকার ওষুধের ফার্মেসিগুলো ঘুরে দেখা যায়, ইকোস্প্রিন ছিল ৬ টাকার জায়গায় ১০ টাকা। ৬০ পয়সা ট্যাবলেট প্রতি দাম থাকলেও তা বাড়িয়ে এখন ৮০ পয়সা করা হয়েছে। সেই হিসাবে ৮ টাকা পাতা হওয়ার কথা থাকলেও বিক্রেতারা তা রোগীদের কাছে বিক্রি করছেন ১০ টাকায়। পাতা প্রতি বেশি রাখা হচ্ছে ২ টাকা করে। একইভাবে জ্বরের চিকিৎসায় ব্যবহৃত নাপা ট্যাবলেটের ১ পাতার আগের দাম পাইকারি পর্যায়ে ছিল ৭ টাকা। ভোক্তাদের কাছে তা বিক্রি হতো ৮ থেকে ১০ টাকা। কিন্তু বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১২ টাকা। লোসারটান পটাশিয়াম ৫০ মিলিগ্রামের প্রতি পিসের দাম আট টাকা থেকে ১০ টাকা করা হয়েছে। প্যারাসিটামল ৫শ’ মিলিগ্রামের ১০ পিস ওষুধের দাম আট টাকা থেকে ১২ টাকা হয়েছে।

প্যারাসিটামল ৬৬৫ মিলিগ্রাম ১০ পিস ওষুধের দাম ১৫ থেকে ২০ টাকা হয়েছে। এ্যামলোডিপাইন এ্যাটেনোলোল ৫শ’ মিলিগ্রামের দাম ছয় টাকা থেকে আট টাকা হয়েছে। ব্রোমাজিপাম ৩ মিলিগ্রামের দাম পাঁচ টাকা থেকে সাত টাকা হয়েছে। ১০ পিস কিনতে আগে ৫০ টাকা লাগত এখন থেকে ৭০ টাকা লাগত। এ্যাসপিরিন ৭৫ মিলিগ্রামের দাম ৬ টাকা ৪০ টাকা থেকে ৮ টাকা টাকা হয়েছে। মেট্রোনিডাজলের দাম ৪শ’ মিলিগ্রামের দাম এক টাকা থেকে হয়েছে দুই টাকা। এই ওষুধের ১০ পিসের দাম ১৪ টাকা ৬০ পয়সা থেকে ৩০ টাকা হয়েছে।

স্বাস্থ্য বিভাগের দাবি, দেশের মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য তালিকাভুক্ত ১১৭টি ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা রয়েছে সরকারের হাতে রয়েছে। কিন্তু রোগীরা অভিযোগ করছেন, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির কারণে যখন তাদের নাভিশ্বাস অবস্থা এমন পরিস্থিতিতে ওই ৫৩ টা ওষুধের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে প্রায় সব ওষুধের দামই।

গত ৩০ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত ওষুধের মূল্য নির্ধারণ কমিটির ৫৮তম সভায় ওষুধের পুনর্নির্ধারিত দাম অনুমোদন করা হয়। ওই সময় জরুরী ব্যবহৃত ৫৩টি ওষুধের দাম পুনর্নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে প্যারাসিটামল ৫০০ এমজি ট্যাবলেটের দাম ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ১ টাকা ২০ পয়সা, প্যারাসিটামল ৫০০ এমজি ট্যাবলেটের (র‌্যাপিড) দাম ৭০ পয়সা থেকে করা হয় ১ টাকা ৩০ পয়সা, প্যারাসিটামল ৬৫০ এমজি ট্যাবলেটের (এক্সআর) দাম ১ টাকা ৩১ পয়সা থেকে করা হয় ২ টাকা, প্যারাসিটামল ১০০০ এমজি ট্যাবলেটের দাম করা হয়েছে ২ টাকা ২৫ পয়সা যা আগে ছিল ১ টাকা ৪ পয়সা, একইভাবে প্যারাসিটামল ৮০ এমজি ড্রাপস ১৫ এমএল বোতলের দাম করা হয় ২০ টাকা যা আগে বিক্রি হতো ১২ টাকা ৮৮ পয়সায়, প্যারাসিটামল ৮০ এমজি ড্রাপস ৩০ এমএল বোতলের দাম হয় ৩০ টাকা, এর আগের দাম ছিল ১৮ টাকা, প্যারাসিটামল ১২০ এমজি/৫ এমএল সাসপেনশন (৬০ এমএল) বোতলের দাম হয়েছে ৩৫ টাকা, আগের দাম ১৮ টাকা, প্যারাসিটামল ১২০ এমজি/৫ এমএল সাসপেনশন ১০০ এমএল বোতলের দাম হয়েছে ৫০ টাকা, আগের দাম ৩০ টাকা ৮ পয়সা  প্যারাসিটামল ১২০ এমজি/৫ এমএল সিরাপ (৬০ এমএল) বোতল দাম ৩৫ টাকা, আগের মূল্য ১৮ টাকা, প্যারাসিটামল ১২০ এমজি/৫ এমএল সিরাপ (১০০ এমএল) বোতলের দাম করা হয়েছে ৫০ টাকা, আগের মূল্য ২৭ টাকা ৭২ পয়সা, মেট্রোনিডাজল ২০০ এমজি ট্যাবলেট কোটেড আগের মূল্য ৬০ পয়সা, বর্তমান মূল্য ১ টাকা, মেট্রোনিডাজল ২৫০ এমজি ট্যাবলেট কোটেড আগের মূল্য ৯২ পয়সা, বর্তমান মূল্য ১ টাকা ২৫ পয়সা, মেট্রোনিডাজল ৪০০ এমজি ট্যাবলেট কোটেড আগের মূল্য ১ টাকা ৩৭ পয়সা, বর্তমান মূল্য ১ টাকা ৭০ পয়সা, মেট্রোনিডাজল ৫০০ এমজি ট্যাবলেট কোটেড আগের মূল্য ১ টাকা ৬৬ পয়সা, বর্তমান মূল্য ২ টাকা, মেট্রোনিডাজল ২০০ এমজি/৫ এমএল সাসপেনশন ৬০ এমএল বোতলের আগের মূল্য ২৬ টাকা, বর্তমান মূল্য ৩৫ টাকা, মেট্রোনিডাজল ২০০ এমজি/৫ এমএল সাসপেনশন ১০০ এমএল বোতলের আগের মূল্য ৩৪ টাকা ৯২ পয়সা, বর্তমান মূূল্য ৪৫ টাকা।

কিন্তু সরকার নির্ধারিত এসব মূল্য বাজারে ফেলেছে পুরোপুরি নেতিবাচক প্রভাব। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে দীর্ঘ দুই মাস যাবত মায়ের কিডনি চিকিৎসা করাচ্ছেন আব্দুল হামিদ। চিকিৎসকদের পরামর্শে নিয়মিত কিছু ওষধ কিনেন হাসপাতালের সামনের স্টার ফার্মেসি থেকে। গত জুন থেকে ওষুধের দাম সরকারের পক্ষ থেকে বাড়ানোর ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সব ওষুধই কিনতে হচ্ছে দ্বিগুণ দামে। এমনিতেই মায়ের চিকিৎসার জন্য অর্থ যোগাড় করতে গিয়ে নাভিশ্বাস বেরিয়ে যাচ্ছে। এর উপর ওষুধের প্রায় দ্বিগুণ দাম মিটাতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

এর আগে সর্বশেষ ২০১৫ সালে কয়েকটি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছিল। এসব বিষয় নিয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক মোঃ আইয়ুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, নিয়ম মেনেই ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, ওষুধের কাঁচামাল ও মোড়কের দাম বেড়ে যাওয়ায় লাভ না হওয়ায় অনেক কোম্পানি ওষুধ উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। তখন বাজারে ওষুধের প্রাপ্যতা কমে যায়। ওষুধ কোম্পানি দাম বাড়ানোর আবেদন করলেই যে আমরা দাম বাড়াব তা নয়। আমরা তাদের খরচ যাচাই করি। একটি টেকনিক্যাল কমিটি ওষুধ উৎপাদনকারীদের প্রস্তাবনা যাচাই-বাছাই করে মূল্য নির্ধারণের সুপারিশ করেছে।
এরপর ওষুধের মূল্য পুনর্মূল্যায়ন করে সেগুলোর নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। আচমকা বাড়ানো হয়েছে বিষয়টা এমন নয়। তিনি আরও বলেন, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে বাজারে ওষুধের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। কোম্পানিগুলো কিছু ওষুধ উৎপাদনে উৎসাহিত হচ্ছে না। সবকিছু পর্যালোচনা করে ওষুধ প্রশাসনের মূল্য নিয়ন্ত্রণ কমিটির পরামর্শক্রমে সরকার ওষুধগুলোর দাম আপডেট করেছে। কিন্তু এটিকে পুঁজি করে কেউ যদি ওষুধের বাড়তি দাম আদায় করে তাহলে এর বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা নিতেই হবে। আমরা বাজার মনিটরিং করছি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।

কিন্তু দাম বাড়ালেও কোন ধরনের যাচাই-বাছাই করা হয়নি উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক জনকণ্ঠকে বলেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য তালিকাভুক্ত ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা সরকারের হাতে রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে আরও যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন ছিল। কিছু কিছু ওষুধের দাম যৌক্তিকভাবে বাড়ানো হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবিত দামের চেয়ে মূল্য অনেকটা বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। এর সুবিধা নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। মাঠপর্যায়ের ফামের্সিগুলোও অধিক মুনাফার লোভে ৫৩টি ওষুধের বদলে অন্যান্য ওষুধেরও দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে করে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষজনকেই। এ জন্য প্রয়োজন কঠোর একটি মনিটরিং টিম। যারা বাজার মনিটর করবে এবং কেউ ওষুদের বাড়তি দাম আদায় করলে সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নেবে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ৬৮ দশমিক ৫০%। এর মধ্যে ৬৪% ব্যয় হয় ওষুধে। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের পরিচালক ডাঃ নুরুল আমিন (গবেষণা) বলেন, চিকিৎসা নিতে গিয়ে ওষুধে মানুষের সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়। ওষুধের দাম বাড়লে আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার আরও বেড়ে যাবে।

কিন্তু দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে দিনশেষে ডলারের উচ্চমূল্যকেই দুষলেন ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ওষুধের কাঁচামাল আমদানির জন্য বছরের শুরুতে এলসি খুলেছিলাম তখন ডলারের দাম ছিল ৮০ টাকায়। এখন যখন শিপমেন্ট এসে পৌঁছাচ্ছে তখন ডলারের দাম উঠেছে ১১০ টাকায়। প্রতি ডলারে ৩০ টাকা করে বেশি দিতে হচ্ছে। প্রাইস পলিসি মোতাবেক প্রত্যেক বছরের বাজারের আর্থিক অবস্থা যাচাই করে এমআরপি পণ্যের দাম নির্ধারণ করার কথা। কিন্তু ২০ বছরেও তা করা হয়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দামও চড়া। এখন কিছু ওষুধের দাম না বাড়ালে প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকা মুশকিল। আমরাও আসলে অসহায়।

 

সূত্রঃ

জনকণ্ঠ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে