বিশ্বব্যাপী মরণব্যাধিগুলোর মধ্যে ক্যানসার অন্যতম। প্রতি বছর বাংলাদেশেও এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার বেড়েই চলছে। তাই ক্যানসার যাতে প্রাথমিক পর্যায়েই প্রতিরোধ করা যায়, সে জন্য এর উপসর্গ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা রাখতে হবে। তবে আশার কথা হলো, প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগ শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করলে জটিলতা এড়ানো যায়।
অ্যামেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির নতুন এক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, অ্যামেরিকায় ৩০ বছর বা তার বেশি বয়সীদের মধ্যে ক্যান্সার সৃষ্টির ঝুঁকি কমানোর মাধ্যমে ক্যান্সারে মৃত্যু প্রায় ৪০ শতাংশ হ্রাস করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা।
সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তা আরিফ কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, মানুষ প্রতিদিন যেভাবে জীবনযাপন করে তাতে কিছুটা পরিবর্তন আনলেই ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
ক্যান্সারের প্রধান কারণ হিসেবে অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে ধূমপান। গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপানের কারণে ৫ ধরণের ক্যান্সার হতে পারে এবং এতে প্রায় এক তৃতীয়াংশ মৃত্যুর ঘটে থাকে।
ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে শরীরের বাড়তি ওজন, অ্যালকোহল গ্রহণ, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা, ডায়েট ও এইচপিভির সংক্রমণ। সামগ্রিকভাবে গবেষকেরা ৩০ ধরণের ক্যান্সারের ১৮টি পরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকির কারণ বিশ্লেষণ করেছেন।
২০১৯ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে ৭০০ হাজারের বেশি নতুন রোগী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ২৬২ হাজারেরও বেশি রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
কামাল বলেন, ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে বা কোনও উৎস থেকে ডিএনএতে সংক্রমণ থেকে যাওয়ার কারণে ক্যান্সার বৃদ্ধি পায়। অন্যান্য বিষয়বস্তু যেমন জেনেটিক্স বা পরিবেশগত কারণগুলোও ক্যান্সার সৃষ্টির পেছনে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে।
সূর্যের আলোর সংস্পর্শে ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ত্বকের ক্যান্সার হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ফ্যাট কোষগুলো যখন হরমোন তৈরি করে তখন সেটি নির্দিষ্ট ক্যান্সারকে শরীরের আরও বিস্তৃত জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে দিতে পারে।
কামাল বলেন, ক্যান্সারের ক্ষেত্রে অনেক সময় মনে হয় যে এর ওপর কারো কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। মানুষ নিজেদের খারাপ জেনেটিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তবে এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব পারেন।
নতুন গবেষণায় পরামর্শ অনুযায়ী, কিছু ক্যান্সার অন্যগুলোর তুলনায় বেশি প্রতিরোধযোগ্য। সংশোধনযোগ্য ঝুঁকির কারণগুলো ৩০ ধরণের ক্যান্সারের মধ্যে ১৯টি ক্যান্সারের ক্ষেত্রে কার্যকরী হয়েছিল।
১০ ধরণের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে পরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকি বা কারণগুলো অন্তত ৮০ শতাংশ নতুন রোগীদের আক্রান্ত হওয়ার জন্য দায়ী। এর মধ্যে ৯০ শতাংশেরও বেশি আলোর অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবের কারণে মেলানোমায় আক্রান্তের ঘটনা। এছাড়াও আছে এইচপিভি সংক্রমণের কারণে হওয়া সার্ভিকাল ক্যান্সারের ঘটনা যা একটি ভ্যাকসিন দিয়েই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকির কারণগুলোর জন্য হওয়া ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্তের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে।
গবেষণায় পুরুষদের মধ্যে ১০৪ হাজারেরও বেশি এবং ৯৭ হাজারেরও বেশি নারীর ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেছে এদের মধ্যে বেশিরভাগেরই ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কারণ ছিল কারণ ছিল ধূমপান। ধূমপানের পরে সবচেয়ে বেশি মানুষের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কারণ ছিল শরীরের অতিরিক্ত ওজন।
পুরুষদের মধ্যে প্রায় ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে এবং নারীদের মধ্যে প্রায় ১১ শতাংশ ক্ষেত্রে এই কারণ দায়ী ছিল।
নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, এন্ডোমেট্রিয়াম, গলব্লাডার, খাদ্যনালী, লিভার এবং কিডনির ক্যান্সারে এক তৃতীয়াংশেরও বেশি মৃত্যু ঘটে এই কারণে।
সাম্প্রতিক আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ওজেম্পিক ও ওয়েগোভির মতো জনপ্রিয় ওজন হ্রাসকারী এবং ডায়াবেটিসের ওষুধ গ্রহণকারী লোকদের জন্য নির্দিষ্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছিল।
অ্যাসোসিয়েশন অফ স্টেইট অ্যান্ড টেরিটোরিয়াল হেলথ অফিসিয়ালসের প্রধান মেডিকেল অফিসার মার্কাস প্লেসিয়া বলেন, ‘স্থূলতা মানুষের জন্য ধূমপানের মতোই ঝুঁকিপূর্ণ।
প্লেসিয়া বলেন, মূল আচরণগত ঝুঁকিপূর্ণ কারণগুলো এড়াতে বেশ কয়েকটি উপায় অবলম্বন করতে হবে। এর মধ্যে ধূমপান ত্যাগ করা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং শরীরচর্চা করা অন্তর্ভুক্ত।
উদাহরণস্বরূপ এটি হৃদরোগ বা ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের হার এবং ফলাফলে অনেক বড় পার্থক্য আনতে পারে। ক্যান্সারও সেই দীর্ঘস্থায়ী রোগগুলোর একটি।
নীতিনির্ধারক ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের এমন পরিবেশ তৈরিতে কাজ করা উচিত যা মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যামেরিকায় ক্যান্সারের প্রারম্ভিক হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস তৈরি করা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী জীবনে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে একটি গভীর পার্থক্য তৈরি হতে পারে।
কামাল বলেন, ক্যান্সার এমন একটি রোগ যেখানে আপনার শরীর প্রতিদিন লড়াই করে আপনার দেহের কোষ বিভাজিত হওয়ার সময়। আপনি প্রতিদিন এই ঝুঁকির সম্মুখীন হন। তাই এই ঝুঁকি কমাতে পারলে আপনি প্রতিদিন উপকৃত হবেন।