ভাইরাসজনিত রোগ নিয়ন্ত্রণে কেবল সুস্থ দেহে অ্যান্টিবডি সৃষ্টির মাধ্যমে ইমিউনিটি (রোগ প্রতিরোধ) বৃদ্ধি করেই সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা হয়। কাজেই কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি (ইমিউনাইজেশন) কেবল হার্ড ইমিউনিটির মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব। হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা হয় টিকার মাধ্যমে সুস্থ মানবদেহে অ্যান্টিবডি (রোগ প্রতিরোধ) তৈরি করে বা ওই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা মানবদেহে সৃষ্ট প্রাকৃতিক ইমিউনিটি থেকে; যা ওই ভাইরাসের পুনরায় আক্রমণকে প্রতিরোধ করে।
কোনো ভাইরাসজনিত রোগ সৃষ্টির পর শরীর নিজের ভেতরে ওই রোগের একটা স্মৃতি রেখে দেয়, যা ওই ভাইরাসকে শনাক্ত করে এবং পুনরায় আক্রমণকে প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। এভাবে কোনো একটি কমিউনিটির ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষের হার্ড ইমিউনিটি অর্জনপূর্বক ভাইরাস সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব। কাজেই বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯-এর টিকাদান কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন ছাড়া কোনোভাবেই করোনা মহামারি থেকে নিস্তব্ধ পৃথিবীতে পুনরায় কোলাহলময় প্রাণের স্পন্দন ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে ১০ কোটি করোনায় আক্রান্তের মধ্যে ২১ লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। সরকারি হিসাবমতে, বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ লোক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং আট হাজারেরও বেশি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে বেশির ভাগ মৃত্যুর ঘটনা হার্ট অ্যাটাকের মাধ্যমেই ঘটে থাকে। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসনালি বা শ্বাসতন্ত্রে ইনফ্লামেশনের ফলে অত্যধিক রক্ত সঞ্চালনের দরুন হার্টের ওপর বারতি চাপ পড়ে বিধায় হার্টের সমস্যাজনিত ব্যক্তির হার্টের কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে যায়।
যা হোক, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বর্তমানে ফাইজার, মডার্না ও অক্সফোর্ডের টিকাগুলো ফ্রন্ট লাইনে রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কেবল ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকাকে জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দিয়েছে। বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে করোনা টিকা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক ধারণাসহ অবিশ্বাস রয়েছে।
সম্প্রতি ফাইজারের করোনা টিকা নেওয়ার পর নরওয়ের বিভিন্ন নার্সিংহোমে ২৩ জনসহ মোট ২৯ জনের মৃত্যুর খবরে টিকা নেওয়ার ব্যাপারে মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার আরও বেড়েছে এবং নরওয়ের মেডিসিন এজেন্সি এদের মধ্যে ৮০ বছরের বেশি বয়স্ক ১৩ জনের মৃত্যুর বিষয়ে তদন্ত করে দেখেছে, তাদের এমআরএনএ টিকাগুলোর সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে জ্বর ও ডায়রিয়ার লক্ষণ ছিল।
নরওয়েতে প্রথমে বয়স্ক লোকদেরই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়া হচ্ছে এবং বিভিন্ন নার্সিংহোমে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত বয়স্ক রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য রাখা হয়েছিল। এসব মৃত্যুর ঘটনা হয়তো করোনা টিকার কারণে ঘটেনি; বরং অত্যন্ত মারাত্মক রোগে ভুগছিল এমন বয়স্ক রোগীদের মধ্যে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে নরওয়ের মেডিকেল এজেন্সির পরিচালক স্বীকার করেছেন। ইতোমধ্যে নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামেও করোনা টিকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে দুই হাজারের মতো বিক্ষোভকারী জমায়েত হয়েছিল।
সম্প্রতি ভারতে টিকার ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া নিয়ে টিকা গ্রহণে এক-তৃতীয়াংশ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাবসহ ভয়ের সঞ্চার হয়েছে। ভারত বায়োটেকের তৈরি কোভ্যাকসিন টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শেষ না হওয়া সত্ত্বেও জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োগের ছাড়পত্র দেওয়াকে কেন্দ্র করে এসব বিতর্ক ও সংশয়ের সূত্রপাত হয়েছে এবং বহু সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা টিকা নিতে চাইছেন না।
এছাড়াও ভারতে প্রথম তিনদিনে প্রায় চার লাখ মানুষকে করোনার টিকা দেওয়ার পর ৫৮০ জনের শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, সাতজনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে হয়েছে এবং দুটি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। যদিও দেশটির সরকার বলেছে, ওই দুজনের মৃত্যুর সঙ্গে করোনার টিকার কোনো যোগসূত্র নেই।
তাছাড়া, ভারত একই সঙ্গে অক্সফোর্ড ও কোভ্যাকসিন টিকা গণহারে প্রয়োগ করছে এবং কোনটির কারণে এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল, তা-ও সরকার নিশ্চিত করেনি। কোভ্যাকসিন টিকার কারণেও হয়তো এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়ে থাকতে পারে, কারণ এটি করোনার স্পাইক প্রোটিন বহনকারী অন্য একটি দুর্বল প্রকৃতির অ্যাডেনোভাইরাস দিয়ে তৈরি, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়টির ট্রায়াল এখনো শেষ হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় বয়স্ক ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দিয়ে ইতোমধ্যে যথাক্রমে প্রায় ১৮৫ লাখ ও ৭.৩ লাখ ডোজ করোনার টিকা দেওয়া হয়েছে এবং টিকা গ্রহণকারী কারও মধ্যে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার খবর পাওয়া যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল ফাইজারের টিকাটির প্রায় ১৮ লাখ ডোজ পর্যালোচনা করে এর সুরক্ষা ও কার্যকারিতা উভয় ক্ষেত্রেই খুব ইতিবাচক ফল পেয়েছে বলে জানিয়েছে।
ফাইজার, মডার্না ও অক্সফোর্ডের টিকাগুলোর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সময় কোনো গুরুতর অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি এবং যাদের তীব্র অ্যালার্জি সমস্যা ছিল তাদের কাউকেই পরীক্ষার কোনোটিতেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যুক্তরাজ্যে ফাইজারের টিকা চালু হওয়ার পর মারাত্মক অ্যালার্জির জরুরি চিকিৎসার জন্য অ্যাড্রেনালাইন পেন বহনকারী দুজনের শরীরে টিকার একটি উপাদান দ্বারা তীব্র অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া (অ্যানাফিল্যাক্সিস) দেখা দিয়েছিল।
কাজেই যাদের শরীরে তীব্র অ্যালার্জির লক্ষণ রয়েছে, তাদের ফাইজারসহ কোনো ধরনের টিকা নেওয়া উচিত নয়। ফাইজারের টিকাটির করোনার স্পাইক প্রোটিন অতি নিম্ন তাপমাত্রায় নষ্ট না হওয়ার জন্য পলিইথিলিন গ্লাইকল (পিইজি) ব্যবহার করা হয়েছে, যা সাধারণত ওষুধে ব্যবহৃত অ্যালার্জেনের (অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী) একটি গ্রুপ হিসাবে পরিচিত। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাতে পিইজি থাকে না, সুতরাং এ উপাদানটি দ্বারা অ্যালার্জি সমস্যা হয় এমন ব্যক্তিরা বিকল্প হিসাবে অক্সফোর্ড টিকা গ্রহণ করতে পারেন।
সুখবর হলো, বাংলাদেশ করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে শিগগিরই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার মাধ্যমে টিকাদান কর্মসূচি শুরু করতে যাচ্ছে। করোনার টিকা নেওয়ার পর অন্যসব টিকার মতোই কারও কারও শরীরে হয়তো হালকা কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন-টিকা প্রয়োগের স্থানের চারদিকে লাল হয়ে ফোলাভাব, বাহুতে ব্যথা, সামান্য সর্দি বা জ্বর, জয়েন্টে বা পেশিতে ব্যথা, ক্লান্তি ভাব ও মাথাব্যথার মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে এবং এ লক্ষণগুলো টিকাটি যে কাজ করছে সাধারণত তার ইঙ্গিত বহন করে।
প্রশ্ন হল, অক্সফোর্ডের টিকায় আদৌ কোনো ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে কি না, যা আমাদের জন্য ভীতির কারণ হতে পারে? অক্সফোর্ডের টিকায় অন্যসব সাধারণ টিকার মতোই সুক্রোজ, অ্যাসিডিটি নিয়ন্ত্রক হিস্টিডিন, সোডিয়াম ও পটাশিয়াম লবণ ছাড়াও পলিসরবেট-৮০, সামান্য পরিমাণ ম্যাগনেসিয়াম (এক মিলিয়নের ৩-২০ অংশ) এবং খুব অল্প পরিমাণে অ্যালকোহল (০.০০৩ মিলিগ্রাম/ডোজ) রয়েছে। এ টিকায় এসব উপাদান খুবই অল্প পরিমাণে রয়েছে এবং এমন কোনো উপাদান নেই, যা আমাদের শরীরে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
আরেকটি সুখবর হচ্ছে, আগামী দিনগুলোয় যুক্তরাজ্য ও ব্রাজিলে শনাক্ত হওয়া নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের মতো মারাত্মক ও আগ্রাসী মিউট্যান্ট স্ট্রেইনের আগেরটির জায়গা দখল করার আগেই বা কর্তৃত্ব নেওয়ার আগেই আমাদের বহু লোক টিকা গ্রহণ করবে এবং জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে যাবে।
অক্সফোর্ডের টিকায় অন্যান্য টিকার মতোই সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (ক্ষতিকর নয়) কারও শরীরে দেখা দিতে পারে, এমনটি মেনে নিয়েই টিকার নেতিবাচক প্রচারে কর্ণপাত না করে বরং টিকা গ্রহণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে সবাইকে টিকা গ্রহণে আগ্রহী করে সরকারের টিকাদান কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিজেকে, নিজের পরিবার ও পাড়া-প্রতিবেশীসহ দেশের জনগণকে করোনার বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলে এ রোগ থেকে সুরক্ষা দিতে হবে। একমাত্র টিকাই পারে আমাদের বাবা-মা ও ছেলেমেয়েসহ সবাইকে করোনার ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে আবার কোলাহলময় স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে।
ড. মো. শফিকুর রহমান : অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়