করোনার ঢেউয়ে আমরা এতটাই ডুবে আছি যে, ডেঙ্গু যে ঘরে ঢুকে পড়েছে প্রথমে কারো নজরেই আসেনি। সম্প্রতি সিটি করপোরেশনগুলো নড়াচড়া শুরু করেছে; হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর জন্য আলাদা চিকিৎসাব্যবস্থা হয়েছে। যে হারে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে চলেছে, সে কারণে অন্য রোগীদের প্রতি নজর দেওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। গত ২৭ জুলাই ১৪৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৪২ জন। চলতি বছরে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত এ নিয়ে এক হাজার ৯৪৫ জন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। মারা গেছে তিনজন। এ সময়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে এক হাজার ৪৩৩ জন।
ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এই মশা সাধারণত ভোরবেলা ও সন্ধ্যার আগে কামড়ায়। সাধারণ চিকিৎসায়ই ডেঙ্গু সেরে যায়, তবে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম বা হেমোরেজিক ডেঙ্গু মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। বর্ষার সময় সাধারণত এ রোগ বৃদ্ধি পায়। এডিস মশার বংশবৃদ্ধি রোধের মাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা যায়।
২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ২০১৯ সালে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বিশ্বজুড়েই ডেঙ্গুর প্রকোপ রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকা ও এশিয়া অঞ্চলে সর্বোচ্চ প্রকোপ লক্ষ করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বেশি পরিলক্ষিত হয়। প্রতিবছর ৫ থেকে ৫০ কোটি মানুষ বিশ্বের ১১১টি দেশে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী গত ৩০ বছরে বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে ৩০ গুণ। এ ছাড়া জিকা, চিকুনগুনিয়া ও ইবোলা ফিভারের প্রাদুর্ভাবও বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরো বলেছে, মশা হলো বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী প্রাণী। জীবাণু বহন ও তা মানুষে ছড়িয়ে দেওয়ার সক্ষমতা থাকায় মশার কারণে বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর লাখো মানুষের মৃত্যু হয়।
ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ আছে। প্রথমবার আক্রান্ত হলে সাধারণত কোনো বড় ধরনের উপসর্গ হয় না। দ্বিতীয়বার অন্য সেরোটাইপ দ্বারা আক্রান্ত হলে বড় ধরনের উপসর্গ হতে পারে। আক্রান্ত রোগীর ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের (Severe)উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এখন অন্যান্য উপসর্গের পাশাপাশি নাক, চোখ, মুখ, মলের সঙ্গে রক্তক্ষরণ হতে পারে। দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে জ্বরের মাত্রা কম হতে পারে। ডেঙ্গু রোগের সাধারণ চিকিৎসা প্যারাসিটামল ওষুধ, শরীরে পানিস্বল্পতা দ্রুত পূরণ ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম। Severe পর্যায়ে চিকিৎসাও খুব জটিল নয়; কিন্তু পর্যবেক্ষণ, বিশেষ করে Plasma leakage-এর অবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। খুব পরিষ্কারভাবে মনে রাখতে হবে, সব জ্বরই ডেঙ্গু নয় এবং প্লাটিলেটের সংখ্যা কমে গেলেই ডেঙ্গু নয়। রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের ওপর নির্ভর করতে হবে। চিকিৎসার জন্য এমবিবিএস ডাক্তার যথেষ্ট, জটিল হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সঠিক কর্মপদ্ধতির জন্য সঠিক পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করতে হবে। এনএস-১ অ্যান্টিজেন ও ডেঙ্গু ভাইরাস অ্যান্টিবডি ছাড়া ডেঙ্গু রোগ শনাক্ত করা সম্ভব নয়। ধারণা থেকে বা উপসর্গ দেখে ডেঙ্গু বলা যাবে না।
মশক ও এর লার্ভা নিধনই হচ্ছে ডেঙ্গু রোগের প্রধান চিকিৎসা। এরপর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। এর প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত হচ্ছে দেশের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো। ভাইরাসজনিত রোগগুলোর কোনো বিশেষ সময়ের ৯ বছরব্যাপী কমবেশি প্রকোপ দেখা যায়। কিন্তু সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো সব সময় প্রকোপের পেছনে পেছনে হাঁটে অথচ হাঁটতে হবে সংক্রমণের আগে আগে। মশক নিধনের ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। যে হারে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে চলেছে—সংশ্লিষ্ট সব মহলের এ বিষয়ে মনোযোগ আরো বাড়াতে হবে, নইলে করোনা আর ডেঙ্গু মিলে আমাদের আরো পর্যুদস্ত করে তুলবে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে নাগরিকদের সম্পৃক্ত করে ডেঙ্গু প্রতিরোধে জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আক্রান্ত হয়ে সংকটাপন্ন হলে কাউকে দায়ী করে তখন লাভ হবে না।
করোনা প্রতিরোধের পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
মশক নিধন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। যারা আইন অমান্য করবে, তাদের জরিমানা করার পাশাপাশি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে সম্পৃক্ত করতে হবে। নাগরিক দায়িত্ব হিসেবে যার যার ঘরে এবং আশপাশের যেকোনো জায়গায় ফুলের টব, প্লাস্টিকের পাত্র, মাটির পাত্র, টিনের কৌটা, পরিত্যক্ত টায়ার, ডাবের খোসাসহ যেসব পাত্রে পানি জমে থাকে তা তিন দিন পর পর অপসারণ করতে হবে। চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভিন্ন ডেঙ্গু সেল গঠন করতে হবে। রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ অবাধ থাকতে হবে।
মশাবাহিত রোগ বা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই সমন্বিত কাজ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন শাখা এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটা কার্যকর সমন্বয় থাকতে হবে। একই সঙ্গে গণমাধ্যমকে নির্দিষ্ট প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে নিয়মিত সঠিক তথ্য সরবরাহ করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক ও সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়