দেশে আক্রান্ত শিশুদের ৮০ শতাংশের ব্লাড ক্যান্সার

0
291
cancer
Spread the love

রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা আব্দুল্লাহ মাহাদী (৭) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দুই বছর আগে তার হঠাৎ জ্বর ও চোখের পাপড়ি ফুলে যায়। স্থানীয় ক্লিনিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্লাড ক্যান্সার শনাক্ত হয়। এর পর এক বছর ঢাকা শিশু হাসপাতালে চলে চিকিৎসা। এখন বিএসএমএমইউর শিশু হেমাটোলোজি ও অনকোলজি বিভাগে চলছে উন্নত চিকিৎসা। বিভাগটির জরিপ বলছে, তাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসা মাহাদীর মতো ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের ৮০ শতাংশই ব্লাড ক্যান্সারের রোগী।

ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের বেশিরভাগ ক্যান্সার জন্মগত হলেও পারিপার্শ্বিক পরিবেশও কম দায়ী নয়। বিভিন্ন দূষণ, ভেজাল খাদ্য, জাঙ্কফুড, খাদ্যপণ্য উৎপাদনে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার, এমনকি রোগ শনাক্তের বিভিন্ন বিকিরণও শিশুদের মধ্যে ক্যান্সার আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। রক্তে সেলগুলো প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হওয়ায় শিশুরা বেশি ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। দেশে ক্যান্সার আক্রান্তের হার বাড়লেও বিপরীতে বাড়েনি চিকিৎসার সক্ষমতা। বিপুল সংখ্যক রোগীর চিকিৎসায় রয়েছে মাত্র ৪৭ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

এমন পরিস্থিতিতে আজ বুধবার বাংলাদেশে ‘বিশ্ব শিশু ক্যান্সার’ দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসটির প্রতিপাদ্য- ‘শিশু ক্যান্সারের উন্নতমানের চিকিৎসা, মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে যৌথ প্রচেষ্টা।’ ক্যান্সারের জন্য দায়ী বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতার পাশাপাশি চিকিৎসার ক্ষেত্র বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। দিবসটি উপলক্ষে সকালে বিএসএমএমইউ, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
শিশু মাহাদীর মা মৌসুমী আক্তার জানান, দুই বছরে ছেলের চিকিৎসায় তিনি দু’বার ভারত গেছেন। সব মিলিয়ে ১০ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। এখন ১৫ দিন পর পর একটি ইনজেশন দিতে হয়, প্রতিটির দাম ৪৫ হাজার টাকা। ধারদেনা করে চিকিৎসা চালাচ্ছেন। কীভাবে টাকা জোগাড় হবে, তা নিয়ে দিশেহারা তিনি।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, দেশে শিশু ক্যান্সারে আক্রান্তের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ইন্টারন্যাশনাল চাইল্ডহুড ক্যান্সার (আইসিসি) বলছে, বিশ্বে প্রতিবছর চার লাখের বেশি শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর দেড় লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে, যার ৫ শতাংশ শিশু। আক্রান্তদের ১০ শতাংশের কম রোগী চিকিৎসার আওতায় আসছে। প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা পেলে উন্নত দেশে ৮০ শতাংশ শিশুকে বাঁচিতে রাখা সম্ভব হচ্ছে, মধ্যম আয়ের দেশে এ হার ৬০ শতাংশ। জিনগতভাবে শিশুরা ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ায় বড় একটি অংশ শনাক্তের বাইরে থেকে যাচ্ছে। আবার শনাক্তদের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ আর্থিক সংকটসহ নানা কারণে মাঝামাঝি পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিচ্ছেন। তবে বাকি ৩০ শতাংশ চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ জীবনযাপন করছেন।

বিএসএমএমইউর শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চিকিৎসা নেয় ৪ হাজার ৬২৬ জন। এতে দেখা গেছে, সেবাগ্রহীতা শিশুদের ৮০ শতাংশ ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। টিউমার ক্যান্সারে ৭ দশমিক ৮ ও অন্যান্য ক্যান্সারে আক্রান্ত ১১ দশমিক ৫৫ শতাংশ। অথচ ২০১৮ সালের তথ্য পর্যালোচনায় সেবাগ্রহীতা শিশুদের ৩৩ ভাগ ব্লাড ক্যান্সারের রোগী পাওয়া যায়।

রাজধানীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেডিয়াট্রিক অনকোলজি বিভাগে শিশুদের ক্যান্সার চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে। আরও সাতটি প্রতিষ্ঠানে শিশু ক্যান্সার বিভাগ থাকলেও সেবার ব্যবস্থা নেই।

বিএসএমএমইউর শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এটিএম আতিকুর রহমান সমকালকে জানান, বিশ্বে প্রতি বছর চার লাখ শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়, যার ২৫ শতাংশই ব্লাড ক্যান্সার। শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সীদের ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্তের ঝুঁকিপূর্ণ সময় ধরা হয়। শব্দ, বায়ু পানিদূষণ, অতিরিক্ত নগরায়ণ, বিভিন্ন প্রযুক্তি ও ডিভাইসে আসক্তি শিশুদের মধ্যে ক্যান্সারের প্রবণতা বাড়ছে। ব্লাড ক্যান্সার প্রতিরোধে এসব অবস্থার উন্নতি এবং অপ্রয়োজনীয় ডিভাইস থেকে শিশুদের দূরে রাখার পরামর্শ দেন এ বিশেষজ্ঞ।

সরেজমিন মঙ্গলবার বিএসএমএমইউর শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগের সামনে অনেককে অপেক্ষা করতে দেখ যায়। শিশু রোগীর অনেকে যন্ত্রণায় ছটফট করছে; আবার কেউ এতটাই কাহিল, মনে হচ্ছে এখনই জীবন প্রদীপ নিভে যাবে! বিএসএমএমইউর পেডিয়াট্রিক অনকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আরিফুল ইসলাম শিশুদের ক্যান্সার আক্রান্তের জন্য খাদ্যাভ্যাসকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অতিরিক্ত ফাস্টফুড গ্রহণ ও কোমল পানীয় পান শিশুদের ক্ষতি ডেকে আনছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সমকালকে বলেন, ক্যান্সার চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধে গুরুত্ব দিতে হবে। সরকার চিকিৎসা প্রসারে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য আট বিভাগে আটটি ক্যান্সার হাসপাতালের কাজ চলছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে