দেশে প্রথম প্রাণঘাতী গ্লান্ডার্স জীবাণুর উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ

0
50
Spread the love

আধুনিক জীবনযাপনের ফলে ঘোড়ার কদর কমার সাথে সাথে আমাদের দেশেও পূর্বের তুলনায় ঘোড়ার সংখ্যা অনেক হ্রাস পেয়েছে। যদিও জামালপুর ও কক্সবাজারে এখনও ঘোড়া কেনাবেচার হাট বসে। মূলত দুর্গম চরাঞ্চলে পরিবহন কাজে  ঘোড়ার ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া মাড়ওয়ারি, অ্যারাবিয়ান ঘোড়াসহ কিছু বিদেশি জাতের ঘোড়ায় দেখতে পাওয়া যায়। ঐতিহ্যবাহী ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা ও ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বিনোদন ভ্রমণে ঘোড়ার ব্যবহার লক্ষ্যণীয়।

ঘোড়ার একটি অতিপ্রাচীন ও মারাত্মক ছোঁয়াচে জুনোটিক রোগ গ্লান্ডার্স। এই রোগ ঘোড়া থেকে মানুষে সহজে ছড়াতে পারে। বাংলাদেশে গ্লান্ডার্সের উপস্থিতি নির্ণয় এবং কোন কোন ফ্যাক্টর এ রোগের ঝুঁকি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে তা জানার জন্য ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভেটেরিনারি অনুষদের মেডিসিন বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. মো. সিদ্দিকুর রহমানের নেতৃত্বে একই বিভাগের অধ্যাপক ড. এ. কে. আনিসুর রহমানের সহযোগিতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত কর্ণেল পলাশ কুমার ভট্টাচার্য ওই গবেষণা কর্ম পরিচালনা করে আসছেন।

মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন কনফারেন্স রুমে কর্ণেল পলাশ কুমার ভট্টাচার্য তার পিএইচডি সেমিনারে এই গবেষণা সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত তুলে ধরেন। এই গবেষণার আওতায় ঢাকা, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম ও চট্টগ্রাম জেলায় প্রতিপালিত ৭৫৩ টি ঘোড়া হতে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এ সকল নমুনা বাকৃবির মেডিসিন বিভাগের ল্যাবরেটরি, জার্মানির ফ্রেডেরিখ লোফলর ইনস্টিটিউট এবং ভারতের ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার অফ ইকুয়াইন এ প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়। এ কাজে ঐ প্রতিষ্ঠান দুটোর বিজ্ঞানী যথাক্রমে ড. হেনরিখ নইবার ও ড. হরিশংকর সিংহ প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও গবেষণা সহায়তা প্রদান করেন।

বাকৃবির অধ্যাপক ড. মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, গ্লান্ডার্স রোগটি পশ্চিমা বিশ্ব থেকে নির্মূল হলেও এখনও মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে এর উপস্থিতি বিদ্যমান। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে এ রোগের প্রকোপ রয়েছে। এ সকল দেশে ২০০৬ সাল থেকে এ রোগের পুনরুত্থান ঘটেছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশের সাথে ৪০০০ কিলোমিটারের অধিক স্থল সীমান্ত রয়েছে যার অনেক স্থান সুরক্ষিত নয়। ফলে এ সীমান্ত এরিয়া দিয়ে প্রায়শই অননুমোদিতভাবে ঘোড়াসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাণী চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে প্রবেশ করে। ফলে প্রাণীর সাথে সাথে ঐ প্রাণীর রোগসমূহও দেশে চলে আসে। তাই এদেশের ঘোড়ার মধ্যে গ্লান্ডার্সের উপস্থিতি থাকা স্বাভাবিক। তবে ইতিপূর্বে বাংলাদেশে এ রোগের উপস্থিতি আছে কিনা তা নিয়ে কোন গবেষণাকর্ম পরিচালিত না হওয়ায় এ সম্পর্কে কোন ধারণা পাওয়া যায়নি, যা শুধু প্রাণী স্বাস্থ্যই নয়, জন স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করেছে। গবেষণা মোতাবেক শতকরা ৩.৪৫ ভাগ ঘোড়ার মধ্যে এ রোগের জীবাণুর উপস্থিতি দেখা গেছে। গবেষণায় পুরুষ ঘোড়ার মধ্যে গ্লান্ডার্সে আক্রান্তের হার বেশি। গবেষণা অনুযায়ী যে সকল ঘোড়ার বয়স ৬ বছরের বেশি এবং গাড়ি টানায় ব্যবহৃত হয় সে সকল  ঘোড়ার এই রোগে বেশি আক্রান্ত।

বাকৃবি থেকে পরিচালিত গবেষণা অনুযায়ী ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও জামালপুর হতে সংগৃহীত নমুনায় গ্লান্ডার্স এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত ফলাফলে আরও দেখা গেছে, এই রোগে আক্রান্ত ঘোড়ার রোগ সম্পর্কিত লক্ষণের উপস্থিতি নূন্যতম অর্থাৎ রোগটির জীবাণু ঘোড়াসমূহে সুপ্ত অবস্থায় ছিল।

গবেষক কর্ণেল পলাশ কুমার ভট্টাচার্য বলেন, গবেষণার আওতায় পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, ঘোড়া পালনে সরাসরি জড়িত বেশিরভাগ মানুষের এ রোগ সম্পর্কে ধারণা নেই। বিশেষত স্বল্প শিক্ষিত ঘোড়া পালকগণের অধিকাংশই এ রোগ সম্পর্কে অবগত নন এবং এ বিষয়ে সচেতন নন। এমনকি কোন ছোঁয়াচে রোগ হলে যে সকল স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে হয় সে সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল নন। এই রোগের জীবাণুর নাম ‘Burkholderia mallei’ যা আমেরিকান রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ক্যাটাগরি ‘বি’ জীবাণু অস্ত্র হিসেবে তালিকাভুক্ত। এ রোগের জীবাণু যুদ্ধ ক্ষেত্রে জীবাণু অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার নজির আছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন যুদ্ধ বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী এই জীবাণু ব্যবহার করেছে। এ রোগে আক্রান্ত হলে মানুষ ও ঘোড়ার মৃত্যুর সম্ভাবনা ব্যাপক কেননা এ রোগের চিকিৎসা এখনও পর্যন্ত অপ্রতুল। এ অবস্থায়  জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি লাঘবে জরুরি ভিত্তিতে জাতীয় পর্যায়ে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করত ৪/৫ বছর মেয়াদি মনিটরিং এবং সার্ভিল্যান্স কর্মসূচি গ্রহণ জরুরি। এছাড়া সরকারি উদ্যোগে বড় পরিসরে এ রোগ নিয়ে আরও গবেষণা পরিচালনা এবং গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে গ্লান্ডার্স প্রতিরোধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।

উল্লেখ্য, গ্লান্ডার্স ঘোড়া থেকে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীতে ছড়াতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত হলে জ্বর, চামড়ায় মারাত্মক ক্ষত, সন্ধিস্থল ফুলে যাওয়া, শ্বাস কষ্ট, রোগা হয়ে যাওয়া, কাশি, নাক দিয়ে ঘন শ্লেষ্মা নির্গত হওয়া, চামড়ায় এলার্জির মত নডিউল হওয়া ইত্যাদি দেখা যায়। তবে ঘোড়াতে এই রোগের জীবাণু দীর্ঘদিন সুপ্ত অবস্থায় রোগের লক্ষণ প্রকাশ ছাড়া অবস্থান করে রোগ ছড়াতে পারে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে