রাজধানীর তিনটি হাসপাতালের নথির সঙ্গে তাদের কাছে থাকা এক্স-রে ফিল্মের গরমিল পেয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শকদল। তাদের হিসাবে, ওই তিন হাসপাতালের প্রায় দেড় লাখ বিভিন্ন আকারের এক্স-রে ফিল্মের হদিস নেই। পরিদর্শকদলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোনো হাসপাতালে ফিল্ম সরবরাহ না করেই বিল নিয়ে গেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আবার কোনো হাসাপাতালে সরবরাহ করা প্যাকেটে ১২৫টির জায়গায় পাওয়া গেছে ১০০টি।
মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (নিটোর) এমন ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের অক্টোবর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শকদল তাদের প্রতিবেদন দেয়।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, যেসব হাসপাতালে অনিয়ম হয়েছে সেখানকার তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অনেকেই এখন আর ওই কর্মস্থলে নেই বা অনেকেই অবসরে গেছেন। ফলে প্রায় তিন কোটি টাকার এই দুর্নীতির বিষয়টি এক ধরনের চাপা পড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে।
মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গত বছরের ৫ মে লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইস কম্পানির কাছ থেকে সাত হাজারটি বা ৭০ প্যাকেট (প্রতি প্যাকেট ১০০টি করে) ১১ ইঞ্চি বাই ১৪ ইঞ্চি মাপের, ২১০ প্যাকেট বা ২১ হাজার পিস ১০ ইঞ্চি বাই ১২ ইঞ্চি মাপের এবং ১৪০ প্যাকেট বা ১৪ হাজার আট ইঞ্চি বাই ১০ ইঞ্চি মাপের এক্স-রে ফিল্ম কেনে। একই কম্পানির কাছ থেকে এর আগে ২০১৯ সালের ৮ ডিসেম্বর ১৩০ প্যাকেট (প্রতি প্যাকেটে ১২৫টি করে) বা ১৬ হাজার ২৫০ পিস ১১ ইঞ্চি বাই ১৪ ইঞ্চি, ৪০০ প্যাকেট বা ৫০ হাজার পিস ১০ ইঞ্চি বাই ১২ ইঞ্চি এবং ১৫০ প্যাকেট বা ১৮ হাজার ৭৫০ পিস আট ইঞ্চি বাই ১০ ইঞ্চি মাপের এক্স-রে ফিল্ম কেনে। ওই বছরের ৯ মে একই কম্পানির কাছ থেকে ওই হাসপাতাল ১৭ প্যাকেট বা এক হাজার ৭০০ পিস ১১ ইঞ্চি বাই ১৪ ইঞ্চি, ১০ প্যাকেট বা এক হাজার পিস ১০ ইঞ্চি বাই ১২ ইঞ্চি এবং ১৫ প্যাকেট বা এক হাজার ৫০০ পিস আট ইঞ্চি বাই ১০ ইঞ্চি মাপের এক্স-রে ফিল্ম কিনেছে।
এই তিন দফা কেনা ফিল্মের সঙ্গে আগের মজুদ মিলে মোট হিসাবে ১১ ইঞ্চি বাই ১৪ ইঞ্চি মাপের ২৫ হাজার ৮৫০ পিস, ১০ ইঞ্চি বাই ১২ ইঞ্চি মাপের ৭৩ হাজার ৫০০ পিস এবং আট ইঞ্চি বাই ১০ ইঞ্চি মাপের ৩৫ হাজার ১৫০ পিস এক্স-রে ফিল্ম হিসাবে থাকার কথা। কিন্তু গত আগস্ট মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শকদল ওই হাসপাতালে গিয়ে বিভিন্ন উপকরণের নথিপত্র এবং মালপত্র খুঁজতে গিয়ে বড় ধরনের গরমিল পায়। ওই পরিদর্শকদল তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, তারা হিসাব অনুযায়ী ১০ ইঞ্চি বাই ১২ ইঞ্চি মাপের ১৯ হাজার ২০০ পিস এবং আট ইঞ্চি বাই ১০ ইঞ্চি মাপের পাঁচ হাজার ৭৫০ পিস মিলে মোট ২৪ হাজার ৯৫০ পিস এক্স-রে ফিল্মের কোনো হদিস পায়নি, যা কেনার জন্য ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ৪৭ লাখ ৮৪ হাজার ৪৫০ টাকা বিল পরিশোধ করেছে সরবরাহকারী কম্পানিকে। পরিদর্শকদল তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে প্যাকেটগুলোতে ১২৫ পিস করে ফিল্ম আছে বলে বিল ভাউচার দেখানো হয়েছে। বাস্তবে ওই প্যাকেটগুলোতে ছিল ১০০ পিস করে ফিল্ম। এ ছাড়া অন্যগুলো কোথায় গেল সেই জবাব ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাত্ক্ষণিকভাবে পরিদর্শকদলকে দিতে পারেনি।
অন্যদিকে রাজধানীর শেরেবাংলানগরের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র (নিটোর) থেকে উধাও হয়ে গেছে ৮৬০ প্যাকেট এক্স-রে ফিল্ম। প্রতিটি প্যাকেটে ১০০ পিস করে ফিল্ম ছিল। প্রতি প্যাকেটের দাম ঠিকাদারি কম্পানিকে পরিশোধ করা হয়েছে ২৭ হাজার টাকা করে মোট দুই কোটি ৩২ লাখ ২০ হাজার টাকা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শকদল ওই হাসপাতালে গিয়ে বিল ভাউচার এবং প্রয়োজনীয় অন্য নথিপত্র ধরে ভাণ্ডারের মালপত্র গুণে ওই ফিল্ম পায়নি। ওই হাসপাতালে সর্বশেষ গত বছরের ৩০ জুন তিন হাজার ৩৫৫ প্যাকেট এক্স-রে ফিল্ম কেনা হয়।
একইভাবে রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হদিস মেলেনি ১২ হাজার পিস আট ইঞ্চি বাই ১০ ইঞ্চি মাপের এক্স-রে ফিল্মের, যা কিনতে হয়েছে ১৮ লাখ ২৪ হাজার টাকায়। শুধু তা-ই নয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শকদল তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে ওই মাপের এক্স-রে ফিল্ম ওই হাসপাতালে ব্যবহার করা হয় না। তবু তা কেনা হয়েছিল এবং টাকাও পরিশোধ করা হয়েছিল। তারপর ওই ফিল্ম কোথায় গেছে, তা তাত্ক্ষণিকভাবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানাতে পারেনি পরিদর্শকদলের সদস্যদের। এ ছাড়া এসব কেনাকাটায় অনেক ক্ষেত্রেই ক্রয়সংক্রান্ত বিধি-বিধান মানা হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে কেনাকাটায় স্বাস্থ্য খাতে দুইভাবে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। এর মধ্যে একাংশ কেনাকাটা হয়েছে সরাসরি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন অপারেশন প্ল্যান বা করোনাসংক্রান্ত জরুরি পরিকল্পনার আওতায়। আরেক অংশ কেনাকাটা হয়েছে প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে নিজস্ব কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের সীমা লঙ্ঘন করে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নিয়েই নিজেদের ইচ্ছামতো কেনাকাটা করেছে; যার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রেই প্রমাণ পাওয়া গেছে মালপত্র বুঝে না পেয়েই বিল পরিশোধ করা হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও কোনো নিয়ম মানা হয়নি। এমনকি প্রায় সব হাসপাতালেই বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিভিন্ন উপকরণ কেনা হয়েছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতায় যে কেনাকাটা হয়েছে, সেখানেও নিয়ম-নীতির চরম লঙ্ঘন ঘটেছে; যার পরিণতিতে অনেক কর্মকর্তার অদলবদল হলেও এসব দুর্নীতির তেমন কোনো আইনগত শাস্তি হয়নি।
তবে এক্স-রে ফিল্ম উধাও হওয়ার বিষয়ে নিটোরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল গনি মোল্লা বলেন, ‘এমন কোনো বিষয় থাকলে নিশ্চয়ই আমার নজরে আসত। আমি চেষ্টা করি যথাসম্ভব স্বচ্ছতার সঙ্গে সব কেনাকাটা করার। কেনাকাটার জন্য আলাদা কমিটিও করে দেওয়া হয়েছে। আমার এখানে অনিয়ম বা দুর্নীতির কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। তবে হয়তো মাঝেমধ্যে কিছু এক্স-রে ফিল্মের সংকট থাকতে পারে। মন্ত্রণালয়ের টিম কী প্রতিবেদন দিয়েছে, সেটি আমার খোঁজ নিয়ে জানতে হবে।’
মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বর্তমান পরিচালক অধ্যাপক ডা. অসীম কুমার বলেন, ‘যখন ওই কেনাকাটা হয়েছে, তখন আমি এখানকার দায়িত্বে ছিলাম না। আমি চলতি বছর জানুয়ারিতে এই হাসপাতালের পরিচালকের দায়িত্বে এসেছি। তবে শুনেছি, এই বিষয়গুলোতে আমার আগে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা মন্ত্রণালয়ের কাছে জবাবদিহি করেছেন। সর্বশেষ অবস্থা কী সেটা খোঁজ নিলে বলা যাবে।’
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রশিদুল নবী বলেন, ‘আমি গত বছর মার্চ মাসে দায়িত্ব নিয়েছি। এর পরে এমন কোনো অডিট আপত্তি বা এক্স-রে ফিল্ম খোয়া যাওয়ার বিষয় আমার নজরে নেই।’