‘সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ, ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ এই স্লোগানটি শোনেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ‘ধূমপান’ শব্দটি ‘ধুম্র’ এবং ‘পান’ শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে গঠিত। ধূম্র শব্দের অর্থ ‘ধোঁয়া’ বা বাষ্প। যেহেতু তামাকজাতীয় পদার্থের ধোঁয়া গ্রহণ করা হয় বা পান করা হয়, তাই একে ধোঁয়া পান বা ধূমপান বলা হয়। বিশ্বব্যাপী ধূমপানের সবচেয়ে প্রচলিত মাধ্যম হলো সিগারেট, বিড়ি বা চুরুট। এগুলো তামাকজাত দ্রব্য হিসেবে পরিচিত, যা মানব শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তামাকজাত দ্রব্যের মধ্যে আরও আছে জর্দা, গুল ইত্যাদি।
একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, বর্তমানে ১০ জন পুরুষের মধ্যে ৪ জন এবং ২০ জন নারীর মধ্যে ৩ জন ধূমপানে আসক্ত।
অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সিগারেটে নিকোটিন সহ ৫৬টি বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ আছে। ধূমপানের ফলে মানুষের ফুসফুস ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে যায়। ধূমপান ফুসফুসের ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া হৃদরোগ, ব্রেইন স্ট্রোক, মুখের ক্যান্সার, গলার ক্যান্সার, পাকস্থলির ক্যান্সার, টিবি বা যক্ষা, অকালে গর্ভপাত, শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত জটিলতা, যৌনশক্তি হ্রাস, গ্যাংগ্রিন, চুল পড়া, চোখে ছানি পড়া ইত্যাদি রোগসমূহের অন্যতম কারণ হলো ধূমপান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বিশ্বের প্রায় ৭০ লাখ মানুষ সরাসরি তামাক সেবনে মৃত্যুবরণ করে, যার অধিকাংশই ঘটে ধূমপানের ফলে। বাংলাদেশের ৩৫ শতাংশ-এর বেশি মানুষ তামাকজাত দ্রব্য বিশেষ করে সিগারেটে আসক্ত।
আরও একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার মৃত্যুবরণ করেন। তবে যারা মনে করেন শুধু সরাসরি ধূমপানের ফলেই এসব ঘটে তাদের ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। কীভাবে? বলছি। নিজে ধূমপান না করলেও এর প্রভাবে ধূমপায়ীদের সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তিরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এটিকে পরোক্ষ ধূমপান বলা হয়। বিশেষ করে শিশু সহ অধূমপায়ী নারীরা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার বেশি হয়। রাস্তায় প্রায়ই দেখা যায় ছোট সন্তানকে পাশে রেখে বাবা-মা ধূমপান করছেন। তবে এর ফলে বাচ্চার যে কত বড় ক্ষতি হচ্ছে তা তিনি বুঝতেই পারছেন না। ঘরের ভেতর অনেকে ধূমপান করেন। সেখানেও স্বামী-স্ত্রী বা বাচ্চারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। মানা করলে হচ্ছে ঝগড়া, মান-অভিমান। পথে-ঘাটে, হাট-বাজারে, অফিস-আদালতে, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে এমনকি গণপরিবহণেও দিন দিন ধূমপানের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরোক্ষ ধূমপানের ফলে শিশুদের মৃত্যু সহ মারাত্মক নানান ঝুঁকি সৃষ্টি। একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, পরোক্ষ ধূমপানের ফলে নিউমোনিয়া ও অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়ে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর প্রায় ২ লক্ষ শিশু মৃত্যুবরণ করে। পরোক্ষ ধূমপানের ফলে পিসিএসও আক্রান্ত নারীদের গর্ভধারণ জনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ধূমপায়ীরা নিজেদের পাশাপাশি যে অন্যদেরও ক্ষতি করছে তা উপলব্ধি না করা পর্যন্ত এই সমস্যা সমাধান প্রায় অসম্ভব। তবে দেশের সরকার কর্তৃক কঠোর বিধি-নিষেধ জারি করা হলে এর হার কিছুটা হলেও কমতে পারে। পাশাপাশি প্রয়োজন পরিবার, সমাজ, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বা প্রিয়জনদের উৎসাহ-অনুপ্রেরণা।
ভারতের বিখ্যাত ইয়াশোদা হসপিটালস, হায়দ্রাবাদ এর কনসালটেন্ট পালমোনোলজিস্ট ডা. চেতান রাও ভাদেপাল্লির ভাষ্যমতে, পরোক্ষ ধূমপান ব্যক্তির রক্ত ও রক্তনালীতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, যা হার্ট জনিত জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়। বিশেষ করে যারা ইতিমধ্যেই হৃদরোগে আক্রান্ত তাদের এই ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। বাড়িতে বা কর্মক্ষেত্রে পরোক্ষ ধূমপায়ীদের ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্তের ঝুঁকি ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। পরোক্ষ ধূমপানের ফলে শরীরের কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পাশাপাশি ক্যান্সার প্রক্রিয়া গতিশীল হয়। সরাসরি ধূমপানের মতোই সময়ের সাথে সাথে পরোক্ষ ধূমপানের ফলে ক্ষতি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বাড়তে থাকে ফুসফুসের ক্যান্সার আক্রান্তের ঝুঁকিও। তাই এটিকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া এবং সতর্কতা অবলম্বন অত্যাবশ্যক।