নভেম্বর-জানুয়ারি নিয়েই দুশ্চিন্তা!

0
863
Spread the love

শীতকালে বাড়তে পারে করোনা । সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে চলছে আলোচনা । নতুন রোডম্যাপ তৈরি করেছে সরকার । মাস্ক না পরায় ঝুঁকি বাড়ছে
নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত শীত মৌসুমে করোনা সংক্রমণের হার বাড়ার আশঙ্কায় দুশ্চিন্তা বাড়ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, শীতপ্রধান দেশে করোনা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। শীতে সাধারণত যে কোনো ভাইরাসের স্থায়িত্ব বেশি থাকে। বাংলাদেশেও শীত মৌসুমে করোনা সংক্রমণ কিছুটা বাড়তে পারে। এজন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। মেনে চলতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। এ নিয়ে কোনো শৈথিল্য প্রদর্শন করা যাবে না।
করোনা কমে গেছে- এমন ভাবনায় মাস্ক না পরা কিংবা স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে করোনা ব্যাপকভাবে বাড়তে পারে। শীতকালে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও। সংস্থাটি এরই মধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, আসছে শীতে করোনাভাইরাস মহামারী আরও মারাত্মক রূপ নিতে পারে। শীতের আগে থেকেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় করোনা সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করেছে। করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘করোনাভাইরাস শীতকালে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। কারণ এটি শীতকালে বেশি সক্রিয় হয়। করোনা ভ্যাকসিন এলেও মাস্ক পরতে হবে। প্রতিটি নাগরিকের ভ্যাকসিন পাওয়া নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ঝুঁকি আছে। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মাস্ক ব্যবহার করে না। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করা জরুরি।’ গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভার ভার্চুয়াল বৈঠকে শীতের সময় সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘শীতকাল আসন্ন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে করোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে। আমাদের এ মুহূর্ত থেকেই তা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।’ এর পরই ভাইরাসটি মোকাবিলায় শীতকালে কী করা যেতে পারে তা নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে জোর তৎপরতা শুরু হয়। সিনিয়র চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারের পরামর্শক কমিটি প্রকোপ বাড়ার শঙ্কা তুলে ধরে রোডম্যাপ তৈরির পরামর্শ দেয়। এর পরই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি পরিকল্পনা তৈরি করে। মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবদুল মান্নান বলেন, ‘শীতজনিত রোগের চিকিৎসার ওষুধ এবং ভ্যাকসিনের মজুদ ও সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ সূত্র জানান, বাংলাদেশে শীতের সময় করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রকোপ আরও বাড়তে পারে বা দ্বিতীয় ঢেউ আসতে পারে- এমন আশঙ্কা থেকেই সরকার ভাইরাসটি প্রতিরোধ ও চিকিৎসার ব্যাপারে একটি রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। ঠান্ডাজনিত ফ্লুসহ নানা রোগ ও কভিড-১৯ এ দুই ভাগে ভাগ করে চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা সাজানো হয়েছে। প্রথমত ঠান্ডাজনিত নানা রোগের চিকিৎসার ওষুধ বা ভ্যাকসিনের যাতে সংকট না হয় সেজন্য সোমবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর কভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত যেসব হাসপাতাল রোগী না থাকায় অন্যান্য রোগের চিকিৎসার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, শীতের সময় সংক্রমণ বেড়ে গেলে সেগুলোকে আবার করোনা চিকিৎসায় ব্যবহারের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মুখে মাস্ক না পরলে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগের কথাও বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গত বছর ডিসেম্বরে চীনে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয় তখন সেখানে প্রচন্ড শীত ছিল। শীতপ্রধান দেশগুলোতেও করোনার ভয়াবহতা লক্ষ্য করা যায়। এ কারণেই অনেকে বলছেন শীতে করোনা বাড়তে পারে। তবে গরমপ্রধান দেশগুলোতেও যে করোনা হচ্ছে না, তাও নয়। মধ্যপ্রাচ্যে গরম বেশি। সেখানেও করোনা সংক্রমণ আছে। বাংলাদেশেও যখন করোনা শুরু হয় তখন বেশ গরম ছিল। কিন্তু করোনার প্রভাব ততটা কমেনি। আবহাওয়ার সঙ্গে করোনার সম্পর্কের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পাওয়া যায়নি। তবে এটা গবেষণার পর্যায়ে আছে। এও ঠিক, করোনাভাইরাসের গতিবিধি পরিবর্তন হচ্ছে। আমাদের এখন সতর্ক থাকতে হবে বেশি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। বাইরে বেরোলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে এবং সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস ধরে রাখতে হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ বা ঢেউ বলতে বোঝায়, সংক্রমণ কমে যাওয়ার পর আবার বেড়ে যাওয়া। এটা ইউরোপের অনেক দেশেই হচ্ছে। আমাদের দেশে এটা নাও হতে পারে। কারণ কোরবানির সময় আমরা যে হারে আশঙ্কা করেছিলাম, তা কিন্তু হয়নি। বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো তথ্য না থাকলেও আমাদের দেশের করোনা পরিস্থিতির সার্বিক অবস্থায় মনে হচ্ছে, করোনা বৃদ্ধির সম্ভাবনা কম। এটা পর্যায়ক্রমে আরও কমে আসতে পারে। কিন্তু করোনায় স্বাস্থ্যবিধি মানতে কোনো প্রকার শৈথিল্য প্রদর্শন করা যাবে না।’
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঋতু পরিবর্তনের সময় করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। করোনা সংক্রমণের হার তুলনামূলকভাবে কমে যাওয়ায় মানুষ এখন আর স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। এখন এতটাই শৈথিল্য এসেছে যে, করোনাভাইরাস পরীক্ষা করানোর ব্যাপারেও তাদের আগ্রহ কমে গেছে। সবকিছুই স্বাভাবিকতায় ফিরে যাচ্ছে। ফলে সংক্রমণের সঠিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে সামনে সংক্রমণের হার আরও বাড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, সাধারণত শীত মৌসুমে বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকে। ফলে হাঁচি-কাশি দেওয়া হলে বাতাসে জীবাণুর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণাগুলো অনেকক্ষণ ধরে ভেসে থাকে। কিন্তু গরমের সময় সেটা দ্রুত ধ্বংস হয়ে যায়। শীতের সময় দীর্ঘ সময় বাতাসে থাকে। ফলে মানুষের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। তাই করোনার জন্য শীত মৌসুম ঝুঁকিপূর্ণ। সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, পরীক্ষা বাড়ানোর জন্য সব সরকারি হাসপাতালে অ্যান্টিজেন টেস্ট শুরু করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর সাবেক উপপরিচালক ডা. মুখলেসুজ্জামান হিরো বলেন, ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানে করোনা সংক্রমণের প্রথম বা দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে স্বীকৃত কোনো কথা নেই। করোনা এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন অবস্থানের কারণে এটা দুর্বল হচ্ছে। পরিবেশগত কারণে কিংবা মানুষের চলাচল বেড়ে যাওয়া, স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে পারে। এখন মানুষজন বলছে, করোনা নেই। করোনা চলে গেছে। এটা বলে মাস্ক না পরা, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে সভা-সমাবেশ, নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে করোনা আবারও বাড়তে পারে। তবে সামনে শীতকাল। করোনা ঠান্ডায় বেশিদিন বেঁচে থাকে। করোনা শীতপ্রধান দেশেই বেশি। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এতটা সংকটজনক পরিস্থিতি নাও হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে ভয় হলো, করোনা নেই বলে সবাই স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। এটাই নতুন করে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রধান কারণ হতে পারে।’
এদিকে আশাবাদের কথা জানিয়েছেন বিশিষ্ট ভাইরাস বিশেষজ্ঞ অণুজীববিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল। তিনি সম্প্রতি সিঙ্গাপুর যাওয়ার আগে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে শীতের আগেই করোনা সংক্রমণের হার আরও কমে যাবে। আসন্ন শীতের মধ্যেই বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে অ্যান্টিবডি চলে আসবে। এতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হারও কমে যাবে। আমাদের দেশে লকডাউন কার্যকর না হওয়ায় করোনা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এতে ভাইরাসও দুর্বল হয়ে পড়ে। এ কারণে অক্টোবর-নভেম্বরের মধ্যে আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যাবে বলে আশি আশা করছি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইউরোপ-আমেরিকায় ভিন্ন সমস্যা। কারণ তারা একটি গন্ডির মধ্যে সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এতে ৮০ ভাগ মানুষ যে কোনো সময় আক্রান্ত হতে পারে। এত দিনে নিউইয়র্কে মাত্র ২০ ভাগ মানুষের মধ্যে ইমিউনিটি এসেছে।’

সূত্রঃ প্রথম আলো

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে