উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগসহ আরও কিছু রোগ আছে, যার জন্য রোগীর মধ্যে তেমন কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায় না, তেমনি একটি রোগ ডিসলিপিডেমিয়া বা রক্তে চর্বির আধিক্য।
চর্বিকে ইংরেজিতে বলা হয় ফ্যাট। এ ফ্যাটকে মেডিকেলের পরিভাষায় বলা হয় লিপিড। ২০১১-২০১২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের মধ্যে একটি জরিপ কার্য পরিচালনা করা হয়েছিল। ৬৩ হাজার ৭০৮ জনের মধ্যে ১১৭০ জনের ডিসলিপিডেমিয়া পাওয়া গিয়েছিল।
অতি ঝুঁকিতে ছিল- পুরুষ ৬০ শতাংশ আর মহিলা ৪০ শতাংশ। অল্প ঝুঁকিতে ছিল- পুরুষ ৪৪ শতাংশ আর মহিলা ৬৫ শতাংশ। রোগগ্রস্ত মোটা ছিল পুরুষ ৩৯ শতাংশ আর মহিলা ২১ শতাংশ।
আমাদের দেহের রক্তের মধ্যে অনেক উপাদান রয়েছে, যার মধ্যে লিপিড (চর্বি) একটি অন্যতম উপাদান এবং শরীরের জন্য অত্যাবশ্যক। লিপিডের মৌলিক উপাদান ৪টি।
এ উপাদানগুলো রক্তের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে থাকে। যদি কোনো কারণে যে কোনো একটি উপাদান বেশি অথবা কম হয়, তখন-ই তাকে বলে ডিসলিপিডেমিয়া। মোটা মানুষের শরীরে চর্বি বা মেদ বেশি- এটি সত্য। তাই বলে মোটা হলেই যে তার শরীরে লিপিড বেশি থাকবে- এটি সঠিক নয়।
পক্ষান্তরে স্বাভাবিকের তুলনায় কম ওজনের মানুষও ডিসলিপিডেমিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। অর্থাৎ লিপিডের পরিমাণ বেশি থাকতে পারে। অনেকের চোখের উপরের পাতা বা নিচের পাতায় চর্বি জমে ফুলে থাকে, একে বলা হয় জ্যানথেলঅ্যাজমা। রক্ত পরীক্ষা করলে তাদের রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি পাওয়া যায়।
রক্তে চর্বি বাড়ে কেন
ডিসলিপিডেমিয়ার সঠিক কারণ আজও জানা যায়নি। জেনেটিক, বংশগত বা পারিবারিক কারণে রক্তে লিপিডের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। কিছু রোগের কারণে যেমন- হাইপোথাইরয়ডিজম, কুশিংসিন্ড্রম, লিভার ও কিডনির বেশ কিছু রোগ, ডায়াবেটিস, দীর্ঘমেয়াদি স্টেরয়েড ওষুধ সেবন, জন্মবিরতিকরণ পিল সেবন, হরমোন থেরাপি, বেশি ক্যালোরিযুক্ত খাদ্য, চর্বিদার লাল মাংস (গরু, খাসি, হরিণ, ভেড়া ও মহিষ), মদ, সফট ড্রিংক্স, শর্করাজাতীয় খাদ্য, ভাত ও আলু ইত্যাদি বেশি খাওয়া হলে রক্তে লিপিডের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে।
এগুলো ছাড়াও বিষণ্নতাপ্রতিরোধী ওষুধ, মানসিক রোগের ওষুধ সেবনের কারণ, সর্বোপরি অকর্মণ্য জীবনযাপন, বসে-শুয়ে থাকার কারণেও ডিসলিপিডেমিয়া হতে পারে। ভাত ও আলু ট্রাইগ্লিসারাইড বৃদ্ধি করে।
যুক্তরাজ্যে খাদ্য তালিকায় শর্করা ৪৮ ভাগ, আমিষ ১৭ ভাগ এবং চর্বি ১৫ ভাগ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। আদর্শ খাদ্য তালিকায় শর্করা ৫০ ভাগ, আমিষ ১৭ ভাগ এবং চর্বি ৩৩ ভাগ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
পশ্চিমা বিশ্বে বা উন্নত বিশ্বে ওবেসিটি অর্থ- সমস্ত শরীর ফুলে যাওয়া। আমাদের দেশে ওবেসিটি অর্থ- পেট মোটা হয়ে যাওয়া। এটিকে বলা হয় সেন্ট্রাল ওবেসিটি, যা সুস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আমাদের দেশে যার মূল কারণ শর্করাজাতীয় খাদ্য বেশি খাওয়া।
রক্তে চর্বির আধিক্য থেকে জটিলতা
ডিসলিপিডেমিয়ার ক্ষতিকারক দিকগুলো হচ্ছে- স্ট্রোক (মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ), উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, করোনারি হার্ট ডিজিজ (হৃদরোগ), অ্যাকুউট এমআই (মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন) বা হার্ট অ্যাটাক, অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ, পিত্তপাথর, শরীর ব্যথা, মাজা ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। মহিলাদের ক্ষেত্রে বন্ধ্যত্ব ও অনিয়মিত ঋতুস্রাব।
লিপিড রক্তনালির মধ্যে জমা হয়ে রক্তনালি সরু করার কারণে রক্ত চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়ে যে রোগের সৃষ্টি করে তার নাম পেরিফেরাল ভাসকুলার ডিজিজ। এটিও ডিসলিপিডেমিয়ার কারণে হয়ে থাকে।
চিকিৎসা
জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং খাদ্য খানার নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। যারা ওজনাধিক্যে ভুগছেন তাদের ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। লাল মাংস বর্জন করতে হবে। চর্বিদার খাবার, ফাস্ট ফুড, সফট ড্রিংক্স বা কোমল পানীয় খাওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে। ভাত ও আলুর পরিবর্তে যব, গম ও ভুট্টার তৈরি খাদ্য খেতে হবে। শাক-সবজি, ফলমূল ও আঁশযুক্ত খাবার বেশি খেতে হবে। প্রতিদিন সকাল অথবা বিকালে ৪৫ মিনিট করে হাঁটতে হবে। শরীর থেকে ঘাম ঝড়াতে হবে, শারীরিক ও কায়িক পরিশ্রম বেশি করতে হবে।
অলস এবং অকর্মণ্য জীবনযাপন না করাই শ্রেয়। রোগ নির্ণয়পূর্বক চিকিৎসা করতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শানুযায়ী। যাদের রক্তে কোলেস্টেরল বেশি তাদের স্টেটিন এবং যাদের রক্তে টিজি (ট্রাইগ্লিসারাইড) বেশি তাদের ফেনফিব্রেট সেবন করতে হবে। নিয়মিত, পরিমিত এবং দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের ওষুধ যারা নিয়মিত সেবন করছেন, যাদের রক্তের কোলেস্টেরল স্বাভাবিক আছে তাদেরও সারা জীবনের জন্য স্টেটিন বাড়তি সেবন করতে হয়। তবে এ ওষুধ অবশ্যই একজন রেজিস্ট্রার চিকিৎসকের পরামর্শে সেবন করা উচিত। কারণ এ ওষুধের বেশ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। সে কারণে ডোজ বা মাত্রা একজন চিকিৎসক-ই নির্ধারণ করবেন।
প্রতিদিন খেতে অভ্যাস করুন
আঁশযুক্ত খাবার, টাটকা শাক-সবজি, ফলমূল, কলা, লেবু ও শিমজাতীয় খাদ্য, টমেটো, শশা, পেঁয়াজ, রসুন, কালোজিরা ও সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদি।
আপনি অসুস্থ নন তার মানে এ নয় যে, আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ। উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট ও ক্যান্সার, কিডনি রোগ, ডিসলিপিডেমিয়া ও এইডস- এ
রোগগুলো বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর কারণ। এক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় আপনার এবং আপনার প্রিয়জনের জীবন রক্ষা করতে পারে।
লেখক : ডা. রফিক আহমেদ
সহকারী অধ্যাপক, বক্ষব্যাধি বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল