বনাঞ্চলে পশুপাখি শিকার করা হচ্ছে অবৈধভাবে। বেড়েছে বাণিজ্য। বন্যপ্রাণীর মাংস খাওয়াও অনেক দেশে অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। বন্যপ্রাণী মানুষের সংস্পর্শে আসার ফলে রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা বাড়ছে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের উৎস এখনও পুরোপুরি পরিস্কার হয়নি। তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা, বন্যপ্রাণীর বাজার থেকেই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। ফলে চীন সরকার বন্যপ্রাণী বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে নতুন যে রোগগুলো ছড়াচ্ছে, তার ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশের উৎস বিভিন্ন পতঙ্গ ও জীবজন্তু। এর অন্যতম প্রধান কারণ, বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে মানুষের সরাসরি যোগসূত্র ঘটা। কারণ মানুষের উৎপাতে আশ্রয় হারাচ্ছে প্রাণীরা। ফলে মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘাত হচ্ছে।
ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্টের তথ্যমতে, গত ৫০ বছরে বন্য জীবজন্তুর মাংস ভোগ করার প্রবণতা প্রায় ২৬০ শতাংশ বেড়েছে। ফলে পশুর শরীরে বাসা বাঁধা ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সহজেই চলে আসছে মানুষের শরীরে।
ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফান্ড ফর নেচারের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পাঁচ হাজারের বেশি প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, সরীসৃপ ও উভচর প্রজাতির প্রাণী বিশ্ববাজারে কেনাবেচা হচ্ছে। বিশ্বে বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাজার প্রায় দুই হাজার কোটি ডলারের। মাদক, মানব পাচার আর অস্ত্র ব্যবসার পরেই বন্যপ্রাণীর অবৈধ ব্যবসার স্থান।
নিউইয়র্কের ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) বাংলাদেশ প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বন্যপ্রাণী মৃত হোক বা জীবিত, এদের না ধরলে বা ব্যবসা-বাণিজ্য না করলে এরা সাধারণত রোগ ছড়ায় না। বরং মুক্তভাবে প্রকৃতিতে বিচরণের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে ও পৃথিবীকে সুস্থ রাখে।
ডব্লিউসিএসের তথ্যমতে, প্রাণী সংক্রমিত রোগে প্রতি বছর বিশ্বে ২০০ কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত হয় এবং দুই লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। বন্যপ্রাণী খাওয়া ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে কিছু রোগের সম্পর্ক তুলে ধরে সংস্থাটি জানিয়েছে, সিভিয়ার অ্যাকিউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম (সার্স) রোগ বাদুড় থেকে ছোট স্তন্যপায়ী হয়ে মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ে ২০০২ সালে। এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ১৯৯৬ সালে বন্য জলজ পাখি থেকে গৃহপালিত হাঁস-মুরগি হয়ে মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এইচআইভি/এইডস মানবদেহে প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৮১ সালে। বাংলাদেশে প্রথম রোগটি শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। বানর জাতীয় প্রাণীর রক্ত বা দেহনিঃসৃত রসের মাধ্যমে এটি মানুষে ছড়িয়ে পড়ে। ইবোলা ভাইরাস বাদুড় থেকে অন্যান্য স্তন্যপায়ী হয়ে মানবদেহে সংক্রমিত হয় ১৯৭৬ সালে। শূকরের দেহ থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে ২০০৯ সালে দেখা দেয় সোয়াইন ফ্লু।
বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, গত ২৫ বছরে বিশ্বে যোগ হয়েছে ৩৫টি নতুন রোগ। এসব রোগ কিংবা ভাইরাসের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশের জন্ম বিভিন্ন প্রাণী থেকে।
২০১২ থেকে ২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী পাচার ও অপরাধবিষয়ক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে ডব্লিউসিএসের বাংলাদেশ প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পাচার হওয়া বন্যপ্রাণীর মধ্যে ৩৯ শতাংশ স্তন্যপায়ী, ৫ শতাংশ ছোট স্তন্যপায়ী, ৩৫ শতাংশ সরীসৃপ, ২০ শতাংশ পাখি, ১ শতাংশ হাঙর ও শাপলা পাতা মাছ।
এমন পরিস্থিতিতে আজ বুধবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস। এ উপলক্ষে নানা কর্মসূচি পালন করছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া অনেক সংগঠনও কর্মসূচি পালন করবে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তথ্যের বরাত দিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলছে, ১৯৮৯ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে মোট ৪ লাখ ১৬ হাজার ২৫৬ একর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। ফলে বন্যপ্রাণীর ৩৯টি প্রজাতি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ প্রায় ৩০টি প্রজাতি অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে।
বাংলাদেশ বন বিভাগের শেখ কামাল ওয়াইল্ডলাইফ সেন্টারের পরিচালক জাহিদুল কবির বলেন, ট্রান্সবাউন্ডারি পাচার কিছুটা কমে এলেও থেমে নেই অনলাইন ট্রেড। দূরদেশের সঙ্গে এখন বাণিজ্য করার উপায়গুলো বন্ধ। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ভারতে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী চোরাচালান যে কমেছে, তা বলা যাবে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের নির্বাহী কমিটির সদস্য আমিনুর রসুল বলেন, সব উন্নয়ন হচ্ছে বন ও প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে। প্রাণীর আবাসস্থল আর মানুষের আবাসস্থলের মধ্যে দূরত্ব কমে আসছে। মানুষের কিছু কর্মকাণ্ডের জন্যই বর্তমানে বিপর্যয় চলছে। প্রকৃতিকে যখন বাধা দেওয়া হবে, তখন প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবেই।
জুলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক তপন কুমার দে বলেন, গভীর জঙ্গল আসলে এক ধরনের ঢালের মতো, যা বাইরের মানুষদের বন্যপ্রাণীর সংস্পর্শে আসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যখন আমরা বন টুকরো টুকরো করে ফেলি, তখন সেটির গভীরে প্রবেশের রাস্তা তৈরি হয়। এটা টাইম বোমার মতো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, বন্যপ্রাণীর ভাইরাস মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে গেলেই মুশকিল। তখন তা মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মানুষের বন্যপ্রাণী থেকে দূরে থাকতে হবে। বনের প্রাণীকে তাদের মতোই থাকতে দিতে হবে।