শিশুর জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি হলে করণীয়

0
150
Spread the love

একবার জ্বর ও খিঁচুনিতে আক্রান্ত শিশুদের শতকরা ৭০ ভাগ পরবর্তী সময়ে সম্পূর্ণ খিঁচুনিমুক্ত থাকতে পারে, এমনকি কোনো রকম চিকিৎসা ছাড়াই। বাকি শতকরা ৩০ ভাগ ক্ষেত্রে দুই বা ততোধিকবার খিঁচুনিতে আক্রান্ত হতে পারে। জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনিতে ভুগেছে এ রকম শিশুদের শতকরা তিন ভাগ পরে মৃগীরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

বিশেষজ্ঞ শিশু চিকিৎসক তাই প্রথমবার জ্বর ও খিঁচুনিতে আক্রান্ত শিশুর কতকগুলো বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করার পর শিশুকে খিঁচুনি নিরোধক জাতীয় ওষুধ দিয়ে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেন।

এ ক্ষেত্রে শিশুর মা-বাবার উচিত চিকিৎসকের সব নির্দেশ পুঙ্খানুপুঙ্খ মেনে চলা। জ্বরের কারণে খিঁচুনি ঘটার কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন—

♦ জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি সাধারণত পাঁচ মাস বয়স থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। ছেলেদের ক্ষেত্রে এর আশঙ্কা বেশি।

♦ খিঁচুনি ঘটে দ্রুত জ্বর বাড়ার কারণে। বেশি জ্বরের কারণে নয়।

♦ জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি সাধারণত ১০ থেকে ১৫ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয় না।

♦ শিশুকে পরীক্ষা করে কোন সংক্রমণ থেকে জ্বর হয়েছে তার উৎস পাওয়া যায়; যেমন—শ্বাসনালির প্রদাহ, টনসিল, পেটের অসুখ ইত্যাদি।

♦ পরিবারে মা-বাবা বা অন্যান্য ভাই-বোন শৈশবে এ রোগে ভুগেছে—এ রকম ইতিহাস থাকতে পারে।

♦ এ ধরনের খিঁচুনি সাধারণত জ্বরের প্রথম দিনই হয়ে থাকে এবং একবারের জ্বরে খিঁচুনি সাধারণত একবারের অধিক হয় না।

♦ জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনির পরে হাত-পা অবশ হয়ে যায় না।

♦ জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনিতে মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের কোনো সংক্রমণ থাকে না। খিঁচুনির সময়ে বা পরবর্তী সময়ে ইইজি পরীক্ষায় অস্বাভাবিক কোনো কিছু থাকে না।

জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি হওয়ার কারণসমূহ

শ্বাসনালি সংক্রমণ; যেমন—টনসিলের প্রদাহ, কানপাকা রোগ ইত্যাদি। মূত্রনালির সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, শিশুর হামরোগ, রোজিওলা ইনফ্যান্টাম, সেপটিসেমিয়া ইত্যাদি।

লক্ষণ

জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি একটি মারাত্মক লক্ষণ। এতে শিশুর দাঁতে দাঁত লেগে যায়। চোখ উল্টে যায় বা স্থির হয়ে থাকে। মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়। হাত-পায়ে বারবার খিঁচুনি হতে থাকে। এ অবস্থায় শিশু সংজ্ঞাহীন হয়ে যেতে পারে।

জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি দেখা দিলে যা করা উচিত

♦ স্বাভাবিকভাবেই এ অবস্থায় ভীত-শঙ্কিত মা-বাবা ডাক্তারের জন্য ছোটাছুটি করেন, কিন্তু ডাক্তার রোগীকে দেখার আগ পর্যন্ত মা-বাবার করণীয় হচ্ছে শিশুর জ্বর কমিয়ে আনা। জ্বর কমানোর জন্য গামছা বা তোয়ালে ট্যাপের পানিতে ভিজিয়ে পুরো শরীর আলতো করে মুছে দিতে হবে। অনেকে এ সময় শিশুকে লেপ, কাঁথা দিয়ে চেপে ধরেন এবং ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দেন, যা অনুচিত। বরং ঘরের জানালা খুলে উন্মুক্ত বাতাস ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে দিতে হবে। খিঁচুনি অবস্থায় লেপ বা গরম কাপড় দিয়ে চেপে ধরলে শরীরের তাপ আরো বেড়ে যায় এবং তা থেকে খিঁচুনি আরো বেড়ে যেতে পারে। জ্বর কমানোর জন্য ঘরে ফ্যান থাকলে তা চালিয়ে দিতে হবে।

♦ খিঁচুনি চলা অবস্থায় শিশুকে একদিকে কাত করে শুইয়ে দিতে হবে, যাতে মুখের লালা গাল দিয়ে গড়িয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। এ সময় চিত করে শোয়ানো উচিত নয় এবং মাথার নিচে বালিশ দিতে নেই। কারণ এতে মুখের লালা গলার মধ্যে আটকে শ্বাসকষ্টের কারণ হতে পারে। এই খিঁচুনি চলাকালে দাঁত লেগে জিহ্বা কেটে যেতে পারে। খিঁচুনির সময় দাঁতে দাঁত লেগে গেলে অনেকে শিশুর মুখে চামচ বা অন্য কোনো শক্ত জিনিস দিয়ে দাঁত খোলার চেষ্টা করেন। এতে শিশুর মুখে আঘাত লাগতে পারে। তাই প্রয়োজনবোধে এ কাজে রুমাল বা কাপড়জাতীয় অন্য কিছু মুখে দেওয়া যেতে পারে। খিঁচুনি চলা অবস্থায় শিশুকে কখনো একা ফেলে রেখে যেতে নেই।

♦ শিশুর জ্ঞান ফিরলেই কেবল প্যারাসিটামল সিরাপ ৬০ মিলিগ্রাম/কেজি/দৈনিক হিসেবে চার থেকে ছয় ঘণ্টা অন্তর জ্বর যদি ১০০.৪০ ফারেনহাইটের (৩৮০ সে.) বেশি থাকে, তবে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু খিঁচুনির সময় কোনো ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা যেন না করা হয়।

♦ খিঁচুনি বন্ধ করার জন্য ৬-এফজি সাইজের ন্যাজো গ্যাস্ট্রিক টিউব অথবা বাটারফ্লাই নিডলের টিউবের সাহায্যে শিশুর পায়ুপথে ০.৫ মিলিগ্রাম/কেজি/ডোজ হিসেবে ইনজেকশন ডায়জিপাম পুশ করা যেতে পারে। এটি একটি কার্যকর ও বিপদহীন চিকিৎসা।

♦ খিঁচুনি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলে নিকটতম শিশু চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। কোনো সংক্রমণ খুঁজে পাওয়া গেলে তার যথাযথ চিকিৎসা করাতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী
সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে