শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষায় যত কুসংস্কার

0
593
Spread the love

শিশুদের স্বাস্থ্য চিকিৎসায় নানারকম কুসংস্কার ও বিভ্রান্তি রয়েছে। যেমন-গর্ভবতীকে পুষ্টিকর খাবার দিলে শিশু আকারে অনেক বড় হবে, নবজাতকের জন্মের পর মধু, চিনি, মিছরির পানি খাওয়ালে শিশু মিষ্টিভাষী হবে, যে কোনো মানসিক সমস্যাকে জিন-ভূতের আসর বা পূর্বপ্রজন্মের পাপের ফলে হয়, খিঁচুনি বা মৃগীরোগে জুতা শোঁকানো, আঘাত করা হয় ইত্যাদি। এ সবই আমাদের সমাজে প্রচলিত। কিন্তু এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এসব ভ্রান্ত ধারণা প্রসঙ্গে বিস্তারিত লিখেছেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন

গর্ভবস্থায় মা পুষ্টিকর খাবার খেলে শিশু আকারে বড় হয়

গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত ও পরিমিত পুষ্টিকর খাবার খেতে না দেওয়া প্রাচীনকাল থেকে সামাজিক ধারণা, গর্ভাবস্থায় বেশি খাবার খেলে শিশু আকারে স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হবে, ফলে শিশু জন্ম দেওয়ার সময় মায়ের কষ্ট বেশি হবে। তাই গর্ভবতী মাকে প্রয়োজন অনুযায়ী পুষ্টিকর খাবার খেতে দেওয়া হতো না।

বৈজ্ঞানিক তথ্য

প্রকৃতপক্ষে এসব কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে মা ও অনাগত শিশু নানারকম শারীরিক সমস্যায় ভোগে, এমনকি এর ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মা ও শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে। গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত একটি কুসংস্কার আছে, গর্ভাবস্থায় বোয়াল মাছ খেলে শিশুর ঠোঁট বোয়াল মাছের মতো হয়। তাই, গর্ভাবস্থায় বোয়াল মাছ খেতে বারণ। তেমনি, জোড়া-কলা বা জোড়া ফল খেলে যমজ শিশু জন্মায় বলে অনেকেরই একটি ভুল ধারণা আছে।

নবজাতকের মুখে মধু দিলে শিশুর মুখের ভাষা মিষ্টি হয়

নবজাতকের মুখে মধু দিলে শিশুর মুখের ভাষা সুন্দর হয় বলে প্রচলিত ধারণা আছে।

বৈজ্ঞানিক তথ্য

শিশু জন্মের পর সংবেদনশীল থাকার ফলে এ ধরনের অভ্যাস নবজাতকের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। মধু, মিছরির পানি জাতীয় জিনিস খাওয়ানো নবজাতকের জন্য ক্ষতিকর। জন্মের পরপরই মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে এবং অন্য কোনো খাবার নবজাতক শিশুকে দেওয়া একেবারেই অনুচিত। বাড়ির পুরুষের আগে নারীরা খেলে অমঙ্গল হয় বলে প্রচলিত ধারণাটি নারী-পুরুষের বৈষম্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও পরিবারের পুরুষদের জন্য অপেক্ষা করে নারীরা খাবার গ্রহণে বিলম্ব করে থাকে। এতে করে শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হতে পারে।

জিন-ভূতের আছর

অনেকেরই ভ্রান্ত ধারণা মানসিক রোগ জিন-ভূতের আছর। সমাজে এ নিয়ে বিভিন্ন কুসংস্কার আছে। মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণ হিসাবে বলা হয় খারাপ বাতাসের বা ভূত-প্রেতের প্রভাব অথবা কেউ মনে করে, পূর্বজন্মের পাপের ফল। অনেকে এ সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি ‘ভান’ করেছে বলা হয়। যারা আক্রান্ত হচ্ছে তারা বা তাদের পরিবার কোনো পরামর্শক/ডাক্তারের কাছে যাওয়া অপমানজনক মনে করে। যেমন মানসিক রোগ হলে ঝাড়ফুঁক করা, নাকের ভেতর মরিচ দেওয়া, নিমের ডাল বা বাঁশ দিয়ে পেটানো ইত্যাদি। মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে পানির মধ্যে চুবিয়ে রাখা ইত্যাদি। নারীদের ক্ষেত্রে এ অবস্থা আরও করুণ। যদিও মানসিক রোগ অন্যান্য রোগ-ব্যাধির মতোই একটি সমস্যা এবং চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময়যোগ্য।

মানসিক সমস্যাগ্রস্ত মানুষ বেশিরভাগ সময়ই স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। পারিবারিক, সামাজিক বা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড থেকেও তারা পিছিয়ে পড়েন। মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সমাজে অনেক ভ্রান্ত ধারণা, বৈষম্যমূলক আচরণ ও কুসংস্কার প্রচলিত। বৈষম্যমূলক আচরণ যেমন তাদের এক ঘরে করে রাখা, লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখা, পারিবারিকভাবে নির্যাতন করা।

বৈজ্ঞানিক তথ্য

সামাজিকভাবে মূল্যবোধ, আচার-আচরণ, পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে কাজ করলে মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি বৈষম্য, ভ্রান্ত ধারণা এবং কুসংস্কার দূর হবে। প্রারম্ভিক বয়সে (০-৫ বছর বয়স পর্যন্ত) মস্তিষ্ক পরিবেশের নানা বিষয় ধারণ করে। বাকিটুকু পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে শেখে। তাই শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশের সময় পরিবার ও স্কুল শিক্ষকদের ইতিবাচক ব্যবহার করতে হবে।

খিঁচুনি বা মৃগীরোগে জুতা শোঁকানো ও আঘাত করা

আমাদের সমাজে মৃগী রোগ সম্বন্ধে নানা ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। যেমন, এগুলো জিন-ভূতের আছর কিংবা খারাপ হাওয়ার কারণে হয়। রোগীকে খিঁচুনির সময় ‘জুতা শোঁকানো’ ‘আঘাত করা’ ‘গরুর হাড় বা লোহার শিক’ ইত্যাদি মুখে চেপে ধরা হয়।

বৈজ্ঞানিক তথ্য

মৃগী স্নায়ুতন্ত্রের জটিলতাজনিত একটি রোগ। মস্তিষ্কের শরীরের কার্য পরিচালনাকারী জায়গায় স্নায়ুতন্ত্রের উদ্দীপক ও নিবৃত্তিকারক অংশদ্বয়ের কার্যপ্রণালির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে মৃগীরোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। একে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘Epilepsy’ বলে। এ রোগ যে কোনো বয়সে হতে পারে। এটা কোনো সংক্রামক রোগ নয়।

টিকা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা

পোলিওমুক্ত দেশ হিসাবে এবং শিশু মৃত্যু কমিয়ে এনে এমডিজি গোল সময়ের আগেই অর্জনকারী দেশ হিসাবে, সারা বিশ্বে বাংলাদেশে আজ একটি রোল মডেল। কিন্তু টিকা নিতে অনীহা সমাজে আজও বিদ্যমান। সাধারণ মানুষের এমন বিদ্বেষ সত্যিই আশঙ্কাজনক। টিকার প্রতি ভ্রান্ত ধারণা পৃথিবীতে নতুন না। ভ্রান্ত ধারণা পোষণকারীরা অধিকাংশ সময় এটাকে ধর্মের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে ইহুদি নাছারাদের চক্রান্ত বলে প্রচার প্রচারণা করে থাকেন। এ ধরনের কিছু টিকাবিরোধী আছে, তারা নিজ সে কিছু কুসংস্কারে ভোগে। নিজের সন্তান বা বংশধরদের টিকা গ্রহণ থেকে বিরত রাখার মতো ভয়ংকর কাজ করছেন কিছু ধর্মীয় ভুল ধারণা কিংবা অপব্যাখ্যার কারণে তারা মনে করেন রোগ দেওয়ার ও সুস্থ করার মালিক আল্লাহ তাই রোগ হওয়ার আগে প্রতিরোধ করার চেষ্টা অনৈসলামিক।

বৈজ্ঞানিক তথ্য

ভ্যাকসিন ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব দেশেই ব্যবহার করা হয়। এটি শিশুদের সুস্থ থাকার জন্য জন্মগত অধিকার। এত ঘনবসতির, এত কম রিসোর্সের এ দেশে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় টিকার বিকল্প নেই। রোগ হওয়ার আগে প্রতিরোধই উত্তম, এমনকি ইসলাম ধর্মসহ প্রচলিত প্রায় সব ধর্মেই রোগ প্রতিরোধকে উৎসাহিত করা হয়েছে। ভ্যাকসিনের কারণে শিশু অসুস্থ হবে ও মারা যাবে, শিশুর মৃগীরোগ হয়, আটিজম বা মানসিক প্রতিবন্ধী হয় এবং শরীরে ক্যান্সারের মতো রোগ সৃষ্টি হতে পারে। গর্ভবতী মা টিকা নিলে শিশু বিকলাঙ্গ হয়। অথচ অনেক ক্যান্সারেই প্রতিরোধ করে ভ্যাকসিন যেমন হেপাটাইটিস এর ভ্যাকসিন লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধ করে, জরায়ু মুখ ক্যান্সার ভ্যাকসিন জরায়ু মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। সন্তানকে সুস্থ রাখাও বাবা মায়ের দায়িত্ব। তাই আপনি যদি ভ্রান্ত ধারণায় পড়ে আপনার বাচ্চাকে টিকা না দিয়ে ঝুঁকিতে রাখেন তাহলে আপনি তার অধিকার নষ্ট করলেন, বাবা-মা হিসাবে আপনার দায়িত্বের অবহেলা করলেন-নিজে সুস্থ থাকুন আপনার পরিবারকেও সুস্থ রাখুন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে