করোনাভাইরাস সংক্রমণে বিপর্যস্ত বিশ্বে আশার আলো দেখাচ্ছে প্রতিষেধক টিকা। সরকার বলে আসছে, শুরুর দিকেই টিকা পাবে বাংলাদেশ। কিন্তু মাঝখানে দ্রুত টিকাপ্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। সেই অনিশ্চয়তা কাটিয়ে এখন দ্রুতই টিকা পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু কবে, কখন এই টিকা আসছে সেই অপেক্ষায় প্রহর গুনছে গোটা দেশের মানুষ। লক্ষ্য একটাই- প্রাণঘাতী ভাইরাস থেকে রক্ষা। স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃপক্ষ আশ্বস্ত করে বলেছে, আজ বুধবার অথবা আগামীকাল বৃহস্পতিবারের মধ্যে ভারত সরকারের উপহার হিসেবে পাঠানো অক্সফোর্ডের টিকার ২০ লাখ ডোজ দেশে পৌঁছাবে। একইসঙ্গে আগামী ২৫ জানুয়ারির মধ্যে সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ভারত থেকে আরও ৫০ লাখ ডোজ টিকা দেশে পৌঁছানোর কথা। ওই টিকা পৌঁছানোর পরপরই আগামী ২৬ জানুয়ারি থেকে টিকা গ্রহণের জন্য অনলাইনে নিবন্ধন শুরু হবে। তবে আগে টিকা এলে নির্ধারণ করা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের আগেই টিকাদান কার্যক্রম শুরু করার ইঙ্গিত
দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
টিকা পেতে নিবন্ধনের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ‘সুরক্ষা’ নামে একটি অ্যাপ প্রস্তুত করছে। আগামী দুই-একদিনের মধ্যে অ্যাপটি পুরোপুরি প্রস্তুত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হবে। ওই অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন করার পরই টিকা মিলবে। টিকা দেশে আসার পর তা সংরক্ষণ ও বিতরণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পরিকল্পনা নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা ব্যস্ত সময় পার করছেন।
টিকা বিতরণের পরিকল্পনা সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে প্রথম চালানে ৫০ লাখ ডোজ টিকা আসার পর সব জেলায় একইসঙ্গে টিকাদান কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে। প্রাথমিকভাবে স্বাস্থ্যকর্মীদের কিছু টিকা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হবে। এক সপ্তাহ পর সব জেলায় শুরু করা হবে। এটিই প্রাথমিক পরিকল্পনা। তবে টিকা প্রয়োগের বিস্তারিত পরিকল্পনা করতে আগামী মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ওই সভায় টিকাদানের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।
টিকা প্রদানে সরকারি প্রস্তুতি
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৈরি গাইডলাইন মেনে টিকাদান কর্মসূচির সার্বিক প্রস্তুতি চলছে। প্রথমে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় সরাসরি যুক্ত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা টিকা পাবেন। পরে ধাপে ধাপে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী টিকার আওতায় আসবে। টিকা বণ্টনের জন্য সারাদেশে তিন স্তরে কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানে টিকা বিতরণের জন্য ১৫ ধরনের প্রায় ছয় হাজার ৩০০টি স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ১০ ও ২০ শয্যার হাসপাতাল, মা ও শিশু হাসপাতাল, পুলিশ হাসপাতাল, জাতীয় সংসদ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সচিবালয় ক্লিনিক ও সিটি করপোরেশন হাসপাতাল। টিকাদান কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য ৪২ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাদের সহযোগিতা করার জন্য আরও ২৮ হাজার স্বেচ্ছাসেবী যুক্ত থাকবেন। জেলা পর্যায়ে চারটি, উপজেলা দুটি এবং মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ছয়টি দল টিকাদান কার্যক্রমে যুক্ত থাকবে। এর বাইরে কয়েকটি দল বিভিন্ন হাসপাতাল ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করবে। শুরুতে জেলা, উপজেলা ও সিটি করপোরেশন এলাকা হিসাব করে প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হবে।
টিকা পেতে নিবন্ধন করতে হবে অ্যাপে :স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ এই অ্যাপটি তৈরির কাজ শেষ করে এনেছে। এখন শেষ মুহূর্তে এটি রূপান্তরের কাজ চলছে। আজকালের মধ্যে এই অ্যাপটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হবে। টিকা পেতে ‘সুরক্ষা’ নামে অ্যাপে ভোটার আইডি কার্ড দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। এই কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অ্যাপটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। স্মার্ট মোবাইল ফোনে অ্যাপটি ডাউনলোড করে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ থেকেই নিবন্ধন করতে পারবেন। নিবন্ধনের জন্য ফোন নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, নাম, জন্মতারিখ, অন্য কোনো শারীরিক জটিলতা আছে কিনা, পেশা ইত্যাদি বিস্তারিত তথ্য দিতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তি করোনাভাইরাসের দুই ডোজ করে টিকা পাবেন। প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের বিস্তারিত তথ্য অ্যাপের মাধ্যমে জানা যাবে। ভারতসহ অনেক দেশ টিকাদানে এ ধরনের অ্যাপ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। কারা আগে টিকা পাবেন, সেই অগ্রাধিকারের তালিকাটি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন থেকেও সংগ্রহ করা যাবে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন করে টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনার মূল্য লক্ষ্য হলো- প্রক্রিয়াটি সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করা। কারণ অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধনের কারণে সব তথ্য সার্ভারে সংরক্ষিত থাকবে। কারা কোন সময়ে টিকা পাবেন তাও অ্যাপের মাধ্যমে জানা যাবে। একইসঙ্গে প্রথম ডোজ টিকা নেওয়ার পর পরবর্তী ডোজ কতদিন পরে পাওয়া যাবে সে সম্পর্কিত তথ্যও এসএমএসে জানিয়ে দেওয়া হবে। কারণ কোটি কোটি মানুষ যখন টিকা কর্মসূচির আওতায় আসবে, তাদের সুশৃঙ্খল রাখতে হলে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা ছাড়া বিকল্প নেই। অ্যানালগ পদ্ধতিতে এটি সম্ভব নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই অ্যাপের মাধ্যমে টিকাদান কার্যক্রম সম্পন্ন করছে। বাংলাদেশও এই প্রক্রিয়ায় টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করবে বলে জানান তিনি।
উপহারের টিকা আসছে আজকালের মধ্যে :গত সোমবার সরকারি তরফে জানানো হয়েছিল, আজ বুধবার ভারতের উপহার হিসেবে অক্সফোর্ডের টিকার ২০ লাখ ডোজ আসবে। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের জানান, আজ বুধবার অথবা আগামীকাল বৃহস্পতিবার উপহারের টিকা আসছে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, শিডিউল অনুযায়ী টিকা আসবে। আজ বুধবার একটি সিডিউল আছে। অথবা আগামীকাল বৃহস্পতিবারও আসতে পারে। এটিই সর্বশেষ খবর। ভারত এই টিকা আমাদের কাছে পৌঁছে দেবে। আমি বিমানবন্দরে গিয়ে ওই টিকা গ্রহণ করব।
সবকিছু ঠিক থাকলে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে টিকাদানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেজন্য ২৬ জানুয়ারি থেকে অনলাইনে নিবন্ধন করার কথা ছিল। এর আগেই ভারত থেকে উপহারের টিকা চলে আসছে। ওই টিকা এলে সময়সূচিতে পরিবর্তন হবে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, টিকা আগে চলে এলে প্রয়োগও আগে শুরু হবে। ভারত সরকারের উপহার আজকালের মধ্যে পেলে টিকাদান কার্যক্রম আগেই শুরু করা হবে। সারাদেশে পৌঁছাতে কিছুটা সময় লাগবে। সব জায়গায় পৌঁছালে সারাদেশে একযোগে কার্যক্রম শুরু করা হবে। তবে টিকাদান কার্যক্রম শুরু হবে ঢাকা থেকে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী শুরুতেই টিকা নিচ্ছেন; বাংলাদেশেও ওই প্রক্রিয়া হবে কিনা সাংবাদিকদের এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে জাহিদ মালেক বলেন, আপাতত এ ধরনের চিন্তা নেই। শুরুতে ফ্রন্টলাইনার বিশেষ করে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা টিকা পাবেন। এরপর পর্যায়ক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী টিকার আওতায় আসবে।
টিকা সংরক্ষণ হবে যেভাবে :ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে আসা অক্সফোর্ডের টিকা দেশে আসার পর তা সংরক্ষণের জন্য স্থান নির্ধারণ করে রেখেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সংশ্নিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ভারত থেকে আসা টিকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির প্রধান কার্যালয়, কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) এবং রাজধানীর তেজগাঁও সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির নিজস্ব সংরক্ষণাগারে রাখা হবে। এসব টিকা ওয়াক ইন কুলে (ছোট ঘরের মধ্যে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ) রাখা হয়। দেশে ২৯ জেলায় ওয়াক ইন কুল আছে। আরও ১৮ জেলায় ওয়াক ইন কুল তৈরি করা হচ্ছে। আরও বেশি টিকা আসার আগেই এগুলো প্রস্তুত হয়ে যাবে। এছাড়া প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় আইএলআর (হিমায়িত বাক্সের মধ্যে টিকা সংরক্ষণের ব্যবস্থা) আছে। দেশের ৪৮৩টি ইপিআই সেন্টারে আইএলআর আছে। সেখানেও টিকা রাখা হবে। পৃথক হিমায়িত বাক্সের এসব টিকা পরিবহন করা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ডা. শামসুল হক বলেন, কভিড-১৯ টিকা সংরক্ষণের জন্য সব জেলা, উপজেলা ও সিটি করপোরেশনের ইপিআই স্টোরগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে জাতীয় পর্যায়ে কোল্ড চেইন ধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কোল্ডরুম ভাড়া নেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে।