সেবার চেয়ে বাণিজ্যই বেশি। এসব হাসপাতালে রোগীর কাছ থেকে নানা অজুহাতে বাড়তি ফি নেওয়া হয়। অনেক সময় স্বজনদের সঙ্গে করা হয় দুর্ব্যবহার। অনেকেই অভিজাত হাসপাতালে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। হাসপাতালে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একজন চিকিৎসক এসে দেখা মাত্রই দেড়-দুই হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর পদে পদে বিল গুনতে নাভিশ্বাস ওঠে রোগীর স্বজনদের। বিছানার চাদর ধোয়া বা বালিশের কভার পরিবর্তন থেকে শুরু করে সব কিছুতেই উচ্চ হারে বিলের ফর্দ তৈরি করে রোগীর স্বজনদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়।
এদিকে টেলিমেডিসিন সেবা ঘিরে জমজমাট ব্যবসা খুলে বসেছে পাঁচ তারকা হাসপাতালগুলো। করোনায় অনেক চিকিৎসক হাসপাতালে না আসায় টেলিমেডিসিন সেবা নিচ্ছেন রোগীরা। এই সুযোগে মাসে তিনবার পর্যন্ত বিল বাড়ানো হয়। আবার চিকিৎসকরা একই পিপিই পরে দিনভর রোগী দেখলেও প্রতি রোগীর কাছ থেকে আলাদা করে পিপিইর বিল নেওয়া হয়। ভুক্তভোগী একাধিক রোগী ও তার স্বজনরা এসব অভিযোগ করেছেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, অভিজাত হাসপাতালগুলোকে তাদের স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখার নিয়ম বেঁধে দেওয়া আছে। তারা যদি সেবার চেয়ে ব্যবসার মনোভাব বেশি দেখায়, তাতে হাসপাতালের মানের সমস্যা হবে। ইউজিসি অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, করোনাকালে মানুষের জীবন-জীবিকা স্বাভাবিকভাবেই বিপর্যন্ত। এ মুহূর্তে চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সেবার মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। রোগীদের কাছ থেকে কোনোভাবেই বাড়তি ফি নেওয়া উচিত নয়। প্রয়োজনের বাইরে পরীক্ষাও করানো যাবে না। সবাইকে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে।
জানা যায়, করোনা মহামারীর এই সময়ে রোগীদের সহযোগিতা করতে অনেক চিকিৎসক বিনামূল্যে টেলিমেডিসিন সেবা দিয়েছেন। ২৪ ঘণ্টা কোনো ধরনের লাভের আশা ছাড়াই মানবিকতার জায়গা থেকে চিকিৎসা ও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। কিন্তু এ টেলিমেডিসিন ঘিরেই জমজমাট ব্যবসা খুলে বসেছে পাঁচ তারকা হাসপাতালগুলো। করোনার কারণে নিয়মিত চিকিৎসায় থাকা অনেক রোগীই চিকিৎসকের পরামর্শ পাচ্ছেন না। এ সুযোগে পাঁচ তারকা হাসপাতালগুলো ব্যবসার নতুন ফন্দি এঁটে বসেছে। গুলশানের একটি পাঁচ তারকা হাসপাতালে ৫০০ টাকা ভিজিট দিয়ে শুরু করে টেলিমেডিসিন সেবা। আগের দিন ফোন করে সিরিয়াল দিতে হয় রোগীদের।
ওই হাসপাতালে টেলিমেডিসিন সেবা নেওয়া রোগী রোকসানা আক্তার বলেন, ‘আমি ওই হাসপাতালের এক চিকিৎসকের নিয়মিত তত্ত্বাবধানে ছিলাম। করোনায় হাসপাতালে চিকিৎসক না বসায় টেলিমেডিসিনে সেবা নেওয়ার জন্য সিরিয়াল দিলাম। চিকিৎসক পাঁচ মিনিটের মতো কথা বললেন। এ জন্য হাসপাতালে ফি নেওয়া হয়েছে ৫০০ টাকা। এক সপ্তাহ পর আবার যোগাযোগ করতে বললেন। এক সপ্তাহ পর হাসপাতালে যোগাযোগ করলে বলা হয় ফি ৫০০ থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করা হয়েছে। উপায়ান্তর না থাকায় এক হাজার টাকা ফি পরিশোধ করেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিলাম। এক সপ্তাহ পর আবার যোগাযোগ করতে বলা হয়, তখন টেলিমেডিসিন ফি ১ হাজার ৫০০ টাকা। পাঁচ মিনিট রোগী দেখে কোন হিসাবে ১ হাজার ৫০০ টাকা ফি নেন তারা! দেখার কেউ না থাকায় টেলিমেডিসিন সেবার নামে ব্যবসা শুরু করেছে হাসপাতালগুলো।’
করোনাভাইরাস মহামারীতে প্রতিদিনই দেশে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। দেশের পাঁচ তারকা হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের কাছ থেকে প্রতিদিন ৩০০-৫০০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) ফি। চিকিৎসকরা প্রতিদিন একবার করে কভিড-১৯ আক্রান্তদের ভিজিটে আসেন। ওয়ার্ডে ভর্তি সব রোগীকে ওই চিকিৎসক দেখে ব্যবস্থাপত্র নির্ধারণ করে দিয়ে যান। এক পিপিই পরেই চিকিৎসকরা পুরো ডিউটি সম্পন্ন করেন। কিন্তু হাসপাতালের বিলে প্রতিদিন প্রত্যেক রোগীর কাছে থেকে নেওয়া হয় পিপিই বিল।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর অভিজাত একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন সোলাইমান হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমি এবং আমার মা এই হাসপাতালের এক কেবিনে চিকিৎসাধীন ছিলাম। হাসপাতালের বিলে প্রত্যেকের কাছ থেকে চিকিৎসকের ব্যবহৃত পিপিইর জন্য আলাদা বিল নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের তো এক পিপিই পরেই সেবা দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তারা তো আর পিপিই পাল্টাননি। একইভাবে অন্য রোগীদের কাছে থেকেও পিপিই বিল নেওয়া হয়েছে। শুধু পিপিই নয়, কেবিন পরিষ্কার চার্জ, আয়ার চার্জ সবই আমাদের বিলে আলাদা করে যোগ করা হয়েছে। অথচ একজন রোগী থাকলেও কেবিন পরিষ্কার করতে হতো। আমাদের হাতে লাখ টাকার বিল ধরিয়ে দিয়ে লাভবান হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।’
আরেক হাসপাতালে যে কোনো সেবার জন্য পিপিই বাবদ রোগীদের কাছ থেকে ২০০ টাকা নেওয়া হয়। ওই টাকায় চিকিৎসক, স্যাম্পল কালেক্টরসহ হাসপাতালের স্টাফরা পিপিই ব্যবহার করেন। ওই একটি পিপিই পরে অনেক রোগীকে সেবা দেন চিকিৎসক ও স্টাফরা। অথচ প্রতি রোগী থেকে পিপিই বাবদ টাকা নেওয়া হয় যাতে চিকিৎসক কিংবা নমুনা সংগ্রহকারীরা প্রতি রোগীকে সাক্ষাৎ দেওয়ার আগে ব্যবহৃত পিপিই পাল্টে নতুন পিপিই পরতে পারেন। এতে রোগী সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। হাসপাতালগুলোতে সার্ভিস চার্জ, রুম সার্ভিসের বাইরেও বিছানার চাদর ধোয়া, ঘর পরিষ্কার করার বিলও রোগীদের ধরিয়ে দেওয়া হয়। দুই বেডের রুমে দুই রোগীর কাছে আলাদা করে পরিচ্ছন্নতা খরচ নেওয়া হয়। এতে ওষুধ-ইনজেকশনের দাম, চিকিৎসকদের ফির প্রায় সমান বিল আনুষঙ্গিক খরচে ধরা হয়। এতে সেবা নিতে এসে বিলের বোঝা কাঁধে চেপে যায় রোগীর। বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে চিকিৎসাসেবার মান ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণার পর দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, বাংলাদেশে ষাট শতাংশের বেশি মানুষ বছরে বেসরকারি খাত থেকে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে থাকেন। কিন্তু সেখানে বাণিজ্যিক মুনাফাই মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংস্থাটি বলছে, সরকারি চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে চাহিদা বেশি কিন্তু সরবরাহ নেই। তাই অধিক খরচ করে বেসরকারি চিকিৎসাসেবার দিকে ঝুঁকছেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু সেখানে বাণিজ্যিক মুনাফাই মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।