ট্রায়ালে অংশগ্রহণ অগ্রাধিকার বাড়াবে । কার্যকারিতা তাপমাত্রা, দাম দেখে অন্য প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিতে হবে । সিঙ্গেল ডোজ হতে পারে উত্তম বিকল্প
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনার ভ্যাকসিন কবে আসবে সে নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। কোভ্যাক্স থেকে জুনের আগে ভ্যাকসিন আসার সম্ভাবনা নেই। কেবল একটি উৎসের ওপর নির্ভর করে না থেকে সরকারকে বিকল্প খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ক্ষেত্রে অন্য টিকা উদ্ভাবনকারী প্রতিষ্ঠানের পদ্ধতি, কার্যকারিতা, দাম ও সংরক্ষণের তাপমাত্রা খেয়াল রেখে খোঁজ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ফার্মাকোলজিক্যাল সোসাইটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেছেন, ‘মহামারীতে ভ্যাকসিন দেওয়ার ক্ষেত্রে অধিকাংশ দেশে বেশি ঝুঁকিতে থাকা অল্প মানুষকে অধিক সুরক্ষার আওতায় আনা হচ্ছে। বেশিসংখ্যক মানুষকে মাঝারি সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের ঝুঁকি নিয়ে হলেও হিউম্যান ট্রায়ালে অংশগ্রহণ করতে হবে। এতে বৈজ্ঞানিকভাবে এবং টিকা পাওয়ার অগ্রাধিকার তালিকায় অধিকার জোরদার হবে। বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন বিভিন্ন দেশে অনুমোদন পেয়েছে। পাইপলাইনে আছে ১৪টি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাকসিন। সেগুলোতেও খোঁজ নেওয়া দরকার।’
তিনি বলেন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকো, ফাইজার, মডার্না ছাড়াও অন্য ভ্যাকসিনের উদ্ভাবন পদ্ধতি, কার্যকারিতা, সংরক্ষণ তাপমাত্রা, দাম খেয়াল রেখে যোগাযোগ করা যেতে পারে। সিনোভ্যাক ভ্যাকসিন উদ্ভাবন পদ্ধতি স্বীকৃত ও কার্যকর। কিন্তু এর দাম অতিরিক্ত ধরা হয়েছে। ১৩ থেকে ২৯ ডলার দাম হওয়ার যুক্তি নেই। ক্যানসিনো, নোভাভ্যাক্স, ভেক্টর বায়োটেক, ভারত বায়োটেক, সাইনোফার্ম উহান টিকার ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া যেতে পারে। আমাদের অধিক জনসংখ্যার দেশে সিঙ্গেল ডোজের ভ্যাকসিন জরুরি ছিল। এ ক্ষেত্রে জনসন অ্যান্ড জনসনের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া যেতে পারে। এটা মাইনাস ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায়। এক ডোজের ভ্যাকসিন দিলে আরেক ডোজ উৎপাদন, বণ্টনের সমস্যায় পড়তে হতো না। কিউভ্যাক্স ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ঘোষণা দিয়েছে ঘরের তাপমাত্রাতেই তাদের উৎপাদিত ভ্যাকসিন রাখা যাবে। এগুলোর বিষয়ে খোঁজ নেওয়া যেতে পারে। গতকাল বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টারস ফোরাম আয়োজিত সংলাপে তিনি এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশে সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত ভ্যাকসিনের ‘এক্সক্লুসিভ ডিস্ট্রিবিউটর’ বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কভিশিল্ড ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ার এক মাসের মধ্যে ৫০ লাখ ডোজ টিকার প্রথম চালান পাঠানোর কথা সেরাম ইনস্টিটিউটের। ভারত ৩ জানুয়ারি সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত টিকা ব্যবহারের চূড়ান্ত অনুমোদন দিলে বাংলাদেশেও তা দ্রুত পাওয়ার আশা তৈরি হয়। কিন্তু সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী আদর পুনাওয়ালার বরাত দিয়ে ৩ জানুয়ারি রাতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, রপ্তানি শুরুর আগে আগামী দুই মাস তারা ভারতের স্থানীয় চাহিদা পূরণ করতেই জোর দেবে। ওই খবরে বাংলাদেশের টিকা পাওয়া বিলম্বিত হতে পারে বলে শঙ্কা তৈরি হয়। এ প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন এবং বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান সোমবার দফায় দফায় সংবাদ সম্মেলন করে সবাইকে আশ্বস্তের চেষ্টা করেন। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে টিকা পাঠানোর স্পষ্ট কোনো ঘোষণা সেরাম ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে এখনো আসেনি। ইউনিসেফ বলছে, এখন পর্যন্ত কভিড-১৯ রোগের মোট নয়টি টিকা বিভিন্ন দেশে অনুমোদন পেয়েছে। চলতি বছর বিশ্বব্যাপী ২০ বিলিয়ন ডোজ টিকা তৈরি হতে পারে। বেশ কয়েকটি টিকার অনুমোদন, উৎপাদন ও ব্যবহারও শুরু হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের জনসংখ্যার তুলনায় তা খুবই অপর্যাপ্ত। তাই দেশগুলো যে যেভাবে পারছে টিকা সংগ্রহের জোর চেষ্টা করছে। বিভিন্ন দেশ টিকা কিনছে বিভিন্ন দামে। উদ্ভাবিত টিকাগুলোর ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, মডার্নার টিকার দাম পড়ছে ২৫ থেকে ৩৭ ডলার, সিনোভ্যাক ১৩ দশমিক ৬ থেকে ২৯ দশমিক ৭৫ ডলার, সানোফি ১০ দশমিক ৬৫ থেকে ২১ ডলার, ফাইজার ১৮ দশমিক ৩৪ থেকে ১৯ ডলার, অক্সফোর্ড ৪ থেকে ৮ ডলার, নোভাভ্যাক্স ১৬ ডলার, কিউরভ্যাক্স ১১ দশমিক ৮৪ ডলার, জনসন অ্যান্ড জনসন ১০ ডলার এবং স্পুটনিক ১০ ডলার। এ ব্যাপারে সংলাপে উপস্থিত স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ডা. রশীদ ই মাহবুব বলেছেন, জনগণ ভ্যাকসিনের প্রত্যাশায় রয়েছে। কিন্তু সরকার সরাসরি ভ্যাকসিন আনতে পারেনি। অনেক প্রতিষ্ঠান ট্রায়াল দিতে চেয়েছে, কম দামে ভ্যাকসিন দিতে চেয়েছে কিন্তু সেসব কিছুরই সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে না। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন পেতে দেরি হচ্ছে। অন্য প্রতিষ্ঠান আসার দরজাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এর কারণ হলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিজে স্বচ্ছ নয়। তাদের অব্যবস্থাপনায় আগেও ভুগতে হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে।
বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টারস ফোরামের সভাপতি তৌফিক মারুফের সভাপতিত্বে সংলাপের সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ রাব্বি। অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়েছিলেন কভিড-১৯-বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মহামারী থেকে বাঁচতে সবারই টিকার প্রয়োজন। যাদের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে তাদের তালিকা তৈরি করে আগে টিকা দিতে হবে। কিন্তু এখন তো টিকা পেতেই দেরি হচ্ছে। টিকার জন্য একাধিক সোর্সের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার ছিল। আমরা তা করিনি। উল্টো এ নিয়ে অবহেলা করেছি।’ স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বলেন, ‘এ মহামারীর সময়ে বিষয়টি বড় পরিসরে চিন্তা করা উচিত ছিল। তা হয়নি। বেসরকারি অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ কার্যক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে।’ সংলাপে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, বিএমএ সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ। সংলাপে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে টিকার অগ্রগতি বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, টিকার অগ্রাধিকারভিত্তিক তালিকা প্রণয়ন কার্যক্রম অনেক দূর এগিয়েছে। সম্মুখসারির কর্মরত, যারা সর্বোচ্চ সংক্রমণ ঝুঁকিতে রয়েছেন তাদের আগে টিকা দেওয়া হবে। অ্যাপসের মাধ্যমে টিকা নিতে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। টিকা এলেই নির্ধারিত ব্যক্তিদের ওপর যেন তা প্রয়োগ করা যায়, এ বিষয়ে সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হচ্ছে।