টিকা শুরু ফেব্রুয়ারিতে, যারা পাবেন আগে
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি করোনাভাইরাসের টিকার প্রথম চালান ২৫ জানুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশে পৌঁছাবে বলে আশা করছে সরকার। সবকিছু ঠিক থাকলে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে মাঠপর্যায়ে এ টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সে জন্য ২৬ জানুয়ারিই অনলাইনে নিবন্ধন শুরু হবে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম জানিয়েছেন।
বাংলাদেশে কভিড-১৯ মোকাবিলায় জাতীয়ভাবে টিকাদানের খসড়া পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সে অনুযায়ী সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকাদের অগ্রাধিকার দিয়ে ভ্যাকসিন বণ্টন করা হবে। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই রয়েছে কভিড-১৯ রোগীদের সেবায় সরাসরি নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মী, সম্মুখসারিতে থাকা কর্মী এবং রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল এমন রোগী। দ্বিতীয় ধাপে থাকবে স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে এমন বয়স্ক মানুষ, শিক্ষাকর্মী, জনপরিবহনের কর্মী। তিন পর্যায়ে মোট পাঁচ ধাপে ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজারের বেশি মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা হবে।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে মহাপরিচালক বলেন, ‘বেক্সিমকো ফার্মা আমাদের জানিয়েছে ২১ থেকে ২৫ জানুয়ারি মধ্যে এ টিকা বাংলাদেশে আসবে। টিকা আসার পর দুই দিন বেক্সিমকোর ওয়্যারহাউসে থাকবে।’ সেখান থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের তালিকা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন জেলায় টিকা পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
অধিদফতরের এমএনসিঅ্যান্ডএএইচ অপারেশনাল প্ল্যানের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. শামসুল হক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে টিকা পৌঁছবে ২৭ জানুয়ারি। টিকা পাওয়ার পর কয়েকটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবীদের টিকা দেওয়া হবে। এক সপ্তাহ পর মাঠপর্যায়ে টিকা দেওয়া শুরু হবে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে।’ অক্সফোর্ডের ৩ কোটি ডোজ টিকা আনতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে গত নভেম্বরে যে চুক্তি হয়েছিল তাতে প্রথম চালানে ৫০ লাখ ডোজ টিকা পাওয়ার কথা বাংলাদেশের। বাংলাদেশে সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকার ‘ডিস্ট্রিবিউটর’ হিসেবে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে টিকা সরবরাহ করবে। অক্সফোর্ডের তৈরি এ টিকা প্রত্যেককে দুই ডোজ করে দিতে হয়। সে কারণে স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রথমে পরিকল্পনা করেছিল প্রথম চালানের ৫০ লাখ টিকার অর্ধেক ২৫ লাখ মানুষকে দিয়ে তাদের জন্য বাকি টিকা সংরক্ষণ করা হবে। তবে সে পরিকল্পনায় পরিবর্তন এসেছে জানিয়ে এ বি এম খুরশীদ আলম বলেন, ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার নতুন তথ্যানুযায়ী প্রথম ডোজ দেওয়ার দুই মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া যাবে। সে কারণে প্রথম চালানে পাওয়া টিকা প্রথম মাসেই একসঙ্গে ৫০ লাখ মানুষকে দেওয়া হবে। এর আগে আমাদের জানানো হয়েছিল প্রথম ডোজ দেওয়ার ২৮ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে। সে হিসেবে প্রথমে ২৫ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু গতকাল নতুন নিয়ম জানার পর আমরা পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনেছি। প্রথম যে ৫০ লাখ টিকা আসবে তা দিয়ে দেওয়া হবে। দুই মাসের মধ্যে আরও টিকা চলে আসবে।’ অন্যদের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা ও অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, প্রতি মাসে সরকারের তরফে জানিয়ে দেওয়া হবে কোন মাসে কারা বা কোন শ্রেণির পেশার মানুষ টিকা পাবেন। সে অনুযায়ী তারা মোবাইল অ্যাপে নিজেদের নিবন্ধন করবেন। তালিকা অনুযায়ী কবে কখন কাকে টিকা দেওয়া হবে, কোথায়, কোন সময় তারা টিকা পাবেন তা খুদে বার্তার মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে। সে অনুযায়ী নির্ধারিত কেন্দ্রে হাজির হয়ে তারা টিকা নেবেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যাদের প্রযুক্তিগত দুর্বলতা রয়েছে তাদের সহায়তা করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ ও জনপ্রতিনিধিদেরও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হতে পারে। স্মার্টফোনে ডাউনলোডের পর ফোন নম্বর ও এনআইডি নম্বর দিয়ে ব্যবহারকারীরা অ্যাপে নিজেরা নিবন্ধন করবেন। অ্যাপে নিবন্ধনের সময় নাম, জন্ম তারিখ, এনআইডি নম্বর, অন্য কোনো শারীরিক জটিলতা আছে কিনা, পেশা ইত্যাদি বিস্তারিত তথ্য দিতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তি করোনাভাইরাসের দুটি করে ডোজ পাবেন। তাদের প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের বিস্তারিতও অ্যাপের মাধ্যমে জানা যাবে। প্রতিবেশী ভারতেও টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয়ভাবে এ রকম একটি অ্যাপের ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। টিকাসংক্রান্ত পরিকল্পনাপত্র অনুসারে দেখা যায়, সবার আগে পাবেন সরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রে সরাসরি করোনা রোগীদের সেবায় কাজ করা চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট, টেকনিশিয়ান, ধাত্রী, ফিজিওথেরাপিস্ট, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী ও অ্যাম্বুল্যান্স চালক। পাশাপাশি পাবেন বেসরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রে সরাসরি করোনা রোগীর সেবায় কাজ করা ৬ লাখ চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট, টেকনিশিয়ান, ধাত্রী, ফিজিওথেরাপিস্ট, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী ও অ্যাম্বুল্যান্স চালক। এর পরই টিকা পাওয়ার তালিকায় রয়েছেন হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রে কাজ করা অন্যান্য বিভাগের চিকিৎসক-নার্স ও অন্যরা, মুক্তিযোদ্ধা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সরাসরি করোনায় দায়িত্ব পালন করা কর্মীরা, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য। বিচার বিভাগ, মন্ত্রণালয়, সচিবালয়, জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা। সাংবাদিকদের মধ্যে যারা সরাসরি করোনার খবরাখবর সংগ্রহে কাজ করেছেন, সংসদ সদস্য, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা পর্যায়ক্রমে টিকা পাবেন। অন্য পেশাজীবীরাও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা পাবেন। এসব ধাপে ৫১ লাখ ৮৪ হাজার ২৮২ জনের টিকা দেওয়া শেষ হবে। দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ১৩ কোটি ৮২ লাখ মানুষ পর্যায়ক্রমে করোনাভাইরাসের টিকা বিনামূল্যে পাবে।