১৪ এপ্রিল থেকে সবাইকে এক সপ্তাহ ঘরে থাকতে হবে, সংবাদপত্রসহ জরুরি সেবা ছাড়া যানবাহন গার্মেন্ট কারখানা সব বন্ধ দুই সপ্তাহ পূর্ণাঙ্গ লকডাউন চায় জাতীয় কমিটি, রবিবারের মধ্যে প্রজ্ঞাপন
করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ার হার গুরুতর রূপ নেওয়ায় ১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের কঠোর লকডাউন দিচ্ছে সরকার। ওই লকডাউনের আওতামুক্ত থাকবে জরুরি সেবা। বন্ধ থাকবে সরকারি-বেসরকারি সব অফিস। চলবে না কোনো ধরনের যানবাহন। যথারীতি বন্ধ থাকবে নৌপথ ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট। বন্ধ থাকবে গার্মেন্ট, কলকারখানা, শপিং মহল, দোকানপাটসহ সব প্রতিষ্ঠান। সরকারের পক্ষ থেকে সবাইকে এক সপ্তাহ পুরোপুরি ঘরে থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।
তবে বিধিনিষেধ মেনে খোলা থাকবে ওষুধের দোকান, খাবার দোকানসহ কাঁচাবাজার। হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্সসহ স্বাস্থ্যসরঞ্জাম বহনকারী পরিবহন ছাড়াও খাদ্যপণ্য, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, ফায়ার সার্ভিস, টেলিফোন, স্বাস্থ্য, ত্রাণ বিতরণ, স্থলবন্দর, ইন্টারনেট, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আনা-নেওয়া ও এর সঙ্গে জড়িত অফিসগুলো খোলা থাকবে। চলমান এক সপ্তাহের লকডাউন শেষের আগের দিন আগামীকাল রবিবারের মধ্যেই কঠোর লকডাউনের প্রজ্ঞাপন জারি করে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হবে। এদিকে ১১ এপ্রিলের পর ১২ ও ১৩ এপ্রিল কঠোর বিধিনিষেধের আওতায় থাকবে কি না সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা জানা যায়নি।
গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ঘোষণার পর জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ১৪ এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউনের কথা জানান। সকালে সরকারি বাসভবন থেকে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার। সঙ্গে বাড়ছে জনগণের অবহেলা ও উদাসীনতা তাই সরকার জনস্বার্থে ১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের জন্য সর্বাত্মক লকডাউনের বিষয়ে সক্রিয় চিন্তাভাবনা করছে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ১৪ এপ্রিল থেকে সাত দিনের কঠোর লকডাউন। এ সময়ে জরুরি সেবা ছাড়া সব অফিস ও গার্মেন্ট বন্ধ থাকবে। লকডাউনে কোনো ধরনের যানবাহন চলবে না। ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের কথা চিন্তাভাবনা করেই প্রধানমন্ত্রী একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন আমরা মানুষের জীবন বাঁচাতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, কঠোর লকডাউনের সময়ে জরুরি সেবা ছাড়া সব ধরনের অফিস-আদালত, গণপরিবহন, দোকানপাট, মার্কেট বন্ধ থাকবে। সবকিছু কঠোর লকডাউনের আওতাধীন থাকবে। শিল্পকারখানাগুলোও বন্ধ থাকবে। মানুষ যে যেখানে আছে সেখনেই থাকবে। এটা কঠোর লকডাউন হবে। মানুষকে ঘরে থাকতে হবে। জরুরি ছাড়া কেউ বাইরে আসতে পারবে না, এটা নিশ্চিত করা হবে।
গত কয়েক সপ্তাহে সংক্রমণ বাড়তে থাকায় ৫ এপ্রিল থেকে সাত দিনের কঠোর বিধিনিষেধ জারি করে সরকার। এ বিধিনিষেধের মেয়াদ শেষ হবে আগামীকাল রবিবার। বিধিনিষেধের মধ্যে গণপরিবহন না পেয়ে দুর্ভোগে পড়ে সাধারণ মানুষ। একই সঙ্গে দোকান ও মার্কেট খুলে দিতেও আন্দোলন চলে। পরে ৭ এপ্রিল থেকে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সিটি করপোরেশন এলাকার মধ্যে গণপরিবহন খুলে দেওয়া হয়। গতকাল থেকে ১৩ এপ্রিল সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকানপাট ও শপিং মল খোলা রাখার ঘোষণা দেয় সরকার।
দুই সপ্তাহ পূর্ণ লকডাউনের সুপারিশ : অন্তত দুই সপ্তাহ ‘পূর্ণ লকডাউন’ ছাড়া করোনাভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না বলে মনে করছে কভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। গত বুধবার রাতে কমিটির ৩০তম সভায় তাই সারা দেশে দুই সপ্তাহ ‘পূর্ণ লকডাউন’ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। সভার সুপারিশ নিয়ে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লার সই করা একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে।
কমিটি বিশেষ করে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোয় ‘পূর্ণ লকডাউন’ দেওয়ার সুপারিশ করেছে। লকডাউনের দুই সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগে সংক্রমণের হার বিবেচনা করে আবার নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছে। কমিটি মনে করে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও মৃত্যু হার বৃদ্ধিতে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত যে ১৮টি নির্দেশনা জারি হয়েছিল সেগুলো সঠিকভাবে মানা হচ্ছে না তাই ‘বিধিনিষেধ আরও শক্তভাবে অনুসরণ করা দরকার’।
শয্যাসংখ্যা, আইসিইউ সুবিধা, অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সচেষ্ট উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যেহেতু হাসপাতালে রোগী ভর্তির বাড়তি চাপ বাড়ছে তাই হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা দ্রুত বাড়ানো দরকার। এ ছাড়া ডিএনসিসি হাসপাতাল আগামী সপ্তাহের মধ্যে চালু হবে বলেও জানানো হয়। কমিটি বলছে, করোনাভাইরাসের টেস্ট করতে আসা ব্যক্তিদের একটা বড় অংশ বিদেশগামী যাত্রী। কমিটির মতে বিদেশে অভিবাসী কর্মজীবী মানুষ ছাড়া অন্যদের পরীক্ষার জন্য বেসরকারি পরীক্ষাগারে পাঠানোর বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন। এতে রোগীদের পরীক্ষা ও রিপোর্ট দ্রুত প্রদান করে আইসোলেশন নিশ্চিত করা যাবে, যা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাজ্যে ভ্যাকসিন কার্যক্রম ভালো ফল এনেছে বলে উল্লেখ করেছে কভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। বাংলাদেশেও টিকা কর্মসূচি সফল করতে টিকা সরবরাহ নিশ্চিতে বেসরকারিভাবে আমদানির ওপর জোর দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
বিধিনিষেধ এখন যেভাবে চলছে : ৫ এপ্রিল থেকে সড়ক, রেল, নৌ, অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বন্ধ রয়েছে। তবে গণপরিবহন, উৎপাদন ও সেবার ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হচ্ছে না। বিদেশি ও বিদেশফেরত যাত্রীদের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য হচ্ছে না। অবশ্য এ বিধিনিষেধ দেওয়া হলেও গত বুধবার থেকে মহানগরগুলোয় গণপরিবহন চলতে দেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা ও জরুরি সেবা (গ্যাস, বিদ্যুৎ, ফায়ার সার্ভিস, টেলিফোন, ইন্টারনেট) কাজে নিয়োজিতরা কাজ করবেন, তাদের পরিবহন চলছে। সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অফিস-আদালত কেবল জরুরি কাজ করছে। এদের নিজস্ব পরিবহন চলছে। শিল্পকারখানা, নির্মাণকাজ চলছে। শিল্পকারখানার শ্রমিকদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আনা-নেওয়া করা হচ্ছে। বিজিএমইএ, বিকেএমইকে শ্রমিকদের জন্য ফিল্ড হাসপাতাল করতে হবে বলা হয়েছে। সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত অতি জরুরি (ওষুধ, নিত্যপণ্য কেনা, দাফন, সৎকার) ছাড়া কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে যাওয়া যাচ্ছে না। খাবারের দোকান থেকে খাবার কিনে আনা যাবে। দোকানে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা রাখা যাবে না। শপিং মল বন্ধ, তবে অনলাইনে কেনাকাটা করা যায়। কাঁচাবাজার সকাল ৮টা থেকে ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা সীমিত পরিসরে চালু রয়েছে। তবে গতকাল থেকে শপিং মল, মার্কেট খুলে দেওয়া হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ঢাকায় সীমিত পরিসরে ফিল্ড হাসপাতাল করবে বলা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদিও বিধিনিষেধ পালনে সব ক্ষেত্রেই শিথিলতা দেখা গেছে।
লকডাউনে বন্ধ থাকবে বইমেলা : ১৪ এপ্রিল থেকে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ ঘোষণা হলে ওই সময় বইমেলা বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। গতকাল সন্ধ্যায় গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন তিনি। সে হিসেবে বাংলা একাডেমিকে এক দিন আগেই বইমেলা শেষ করতে হবে। করোনা মহামারীর কারণে এবার ‘অমর একুশে বইমেলা’র ৩৭তম আসর ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে শুরু হয় ১৮ মার্চ। এ মেলা চলার কথা ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। কিন্তু করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে ১৪ এপ্রিল থেকে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’-এর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, ‘লকডাউন শুরু হলে বইমেলা বন্ধ হয়ে যাবে। পুরোপুরি লকডাউন হলে মেলা খোলা রাখার কোনো সুযোগ নেই।’