রাজধানীর উত্তরায় ২০০ বেডের কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালটি দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকেই করোনা রোগীদের জন্য পুরোপুরি ডেডিকেটেড করা হয়েছে। এর আগে হাসপাতালটিতে সব ধরনের রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল। তখন ওই হাসপাতালের ইনডোর ও আউটডোর রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ মজুদ রাখা হয়। করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে যার অনেক ওষুধই প্রয়োজন হয় না। সেসব অনেক ওষুধের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে আবার অনেক ওষুধের মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে।
ওই হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শিহাব উদ্দিন বলেন, ‘অনেক ওষুধই অব্যবহৃত ছিল, এখনো কিছু আছে। আমরা এরই মধ্যে বিপুল পরিমাণ ওষুধ কুর্মিটোলাসহ অন্যান্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছি। কোথাও কোথাও ট্রাক বোঝাই করে নিতে হয়েছে এই ওষুধ। তার পরও এখন যা আছে সেগুলোর বিষয়ে অধিদপ্তরের বিশেষ কমিটি যে সিদ্ধান্ত দেবে, আমরা তা-ই করব।’ ডা. শিহাব উদ্দিন বলেন, ‘যেসব ওষুধের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, সেসব ওষুধ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে ধ্বংস করে ফেলা হয়। বিশেষ করে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয় বা আগুনে পুড়ে ফেলা হয়ে থাকে।’
কেবল এই একটি হাসপাতালেই নয়, গত বছর ঢাকার প্রায় সব কটি সরকারি হাসপাতালেই নন-কভিড রোগীদের সেবা বন্ধ ছিল কয়েক মাস। এখনো নন-কভিড রোগীর চাপ নেই বেশির ভাগ হাসপাতালেই। তবে কভিডের আগে কেনা ওষুধগুলো ঠিকই রয়ে গেছে প্রতিটি হাসপাতালেই। ঢাকার বাইরেও সব হাসপাতালে একই অবস্থা। হাসপাতালগুলো কখনো টেন্ডারের মাধ্যমে আবার কখনো সরাসরি নিজেরাই প্রয়োজনমতো ওষুধ কিনে থাকে সরকারি টাকায়। ফলে সারা দেশেই এখন কমবেশি অব্যবহৃত ওষুধ ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের মজুদ রয়ে গেছে। এর বেশির ভাগই এখন নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিষয়টি নজরে এসেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। ফলে মন্ত্রণালয় থেকে ঢাকাসহ সারা দেশের সব সরকারি হাসপাতালে চিঠি পাঠানো হয়েছে মজুদ থাকা ওষুধ সমন্বয় করে রোগীর সেবায় ব্যবহারের জন্য।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, স্তর ভিন্নতায় বিশেষায়িত বা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতে ১২০ থেকে ১৫০ ধরনের ওষুধ থাকে রোগীদের ফ্রি দেওয়ার জন্য। জেলা হাসপাতালগুলোতে সংখ্যা কিছুটা কম থাকে। উপজেলায় আরো কিছুটা কম থাকে। সর্বনিম্ন ৩০টি থাকে কমিউনিটি ক্লিনিকে। সব স্তরেই কিছু না কিছু ওষুধ উদ্বৃত্ত থেকে যায়।
মানিকগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. গৌতম রায় বলেন, ‘কিছু ওষুধ অব্যবহৃত থেকে যায়, যেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগে আমরা ওয়েবসাইটে বা ই-মেইলে সারা দেশের সব হাসপাতালকে অবহিত করি ওষুধের তালিকা তুলে ধরে। যাদের লাগে তারা এসে নিয়ে যায়। তার পরও কিছু থেকে যায়।’ এই পরিচালক বলেন, ‘আমরা যেগুলো নিজেরা কিনে থাকি, সেগুলোর চেয়ে বেশি উদ্বৃত্ত হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন অপারেশনাল প্ল্যানের আওতায় কিনে আমাদের কাছে পাঠানো ওষুধগুলো। ওই সব ওষুধের এখানে চাহিদা কতটা আছে না আছে সেটার খুব একটা যাচাই করা হয় না। ফলে সেসব ওষুধই বেশি অব্যবহৃত থাকে।’
গত ২ মে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা শাখার উপসচিব ড. বিলকিস বেগম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালকে কভিড ডেডিকেট হিসেবে নির্ধারণ করার পাশাপাশি কোনো কোনো হাসপাতালে একই সঙ্গে কভিড ও নন-কভিড রোগীদের চিকিৎসাসেবা অব্যাহত আছে। কভিডকালীন পরিস্থিতিতে হাসপাতালে নন-কভিড রোগীর সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় হাসপাতালে মজুদকৃত ওষুধ অব্যবহৃত অথবা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সরকারি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে এবং রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা দেওয়ার জন্য দেশের সব হাসপাতালে অব্যবহৃত ওষুধ বিধি মোতাবেক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে রোগীর সেবায় ব্যবহার করতে হবে। চিঠিতে বিষয়টি সমন্বয় ও সার্বিক পরিবীক্ষণের জন্য জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জন ও বিভাগীয় পর্যায়ে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়ের কাছে তথ্য রয়েছে অনেক হাসপাতালেই নানা কারসাজির মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় বা প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ কেনা হয়। কেনার ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা বিভাগ। সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্চা যায় এই অপ্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত ওষুধ কেনার কারণে। আবার দামেও নানামুখী কারসাজি করা হয়। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন অপারেশনাল প্ল্যান থেকে থোক বরাদ্দ ধরে ওষুধ কিনে তা পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন হাসপাতালে