অর্ধেক আইসিইউ সচল নয়

0
868
Spread the love

দেশে করোনা মহামারির মারাত্মক সংক্রমণ চলছে। প্রতিদিন দুইশর ওপরে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। অনেকেই মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিৎসাধীন। যাদের বেশির ভাগেরই সুচিকিৎসার জন্য আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট/নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) সুবিধা দরকার।

কিন্তু দেশের আইসিইউগুলোর করুণদশা বিরাজ করছে। অর্ধেক আইসিইউতে নেই ভেন্টিলেটর সুবিধা, যা আছে সেগুলোও পুরোপুরি কার্যকর নয়। ফলে করোনায় আক্রান্ত অনেকেই শেষ মুহূর্তে যথাযথ চিকিৎসা ছাড়াই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এতে লাফিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মতে, একটি আদর্শ আইসিইউর জন্য বেশকিছু সরঞ্জাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন-আইসিইউ শয্যা, আইসিইউ ভেন্টিলেটর, ইনফিউশন পাম্প বা সিরিঞ্জ পাম্প, নেবুলাইজার মেশিন, পেশেন্ট মনিটর, পালস অক্সিমিটার, সাকশন মেশিন।

এ ধরনের চিকিৎসাসামগ্রী সব আইসিইউতে নেই। অনেক হাসপাতালে আছে; কিন্তু নষ্ট, যন্ত্রটি কাজ করছে না। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেক হাসপাতালে এসব সরঞ্জাম আছে; কিন্ত এগুলো চালানোর মতো লোকবল নেই।

কাজেই সেখানেও আইসিইউ প্রায় অচলই বলা চলে। এভাবে সারা দেশের আইসিইউগুলোতে কোনো না কোনো যন্ত্র বা মানুষের অভাব রয়েছে। কাজেই এগুলো পরিপূর্ণভাবে সচল নয় বলে মনের করেন সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের একটি পুরোনো মেডিকেল কলেজের কোভিড-১৯ আইসিইউতে এক চিকিৎসকের আত্মীয়ের মৃত্যু হয় পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পেয়ে। তিনি খোঁজ নিয়ে দেখেন, ওই আইসিইউতে শয্যাপ্রতি ভেন্টিলেটর মেশিনগুলোর কয়েকটি নষ্ট।

সেখানে রোগীদের বাইপ্যাপ মেশিন দিয়ে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এ ধরনের (বাইপ্যাপ) মেশিন ভেন্টিলেশনের পরিপূরক কোনো যন্ত্র নয়। একই অবস্থা দেশে দক্ষিণবঙ্গের সবচেয়ে পুরোনো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

একজন স্বাস্থ্যকর্মী তার বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে সেখানকার আইসিইউতে রেখেছেন। তিনি বলেন, ওই হাসপাতালেও ২০ শয্যার আইসিইউ রয়েছে। যার অর্ধেক শয্যার যন্ত্রপাতি নষ্ট।

সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা জানান, রাজধানীর কয়েকটি ছাড়া দেশের বেশির ভাগ আইসিইউর এই করুণদশা, যেখানে শয্যা থাকলেও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জামের অভাব রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে দেশে কোভিড-১৯ রোগীর জন্য মোট আইসিইউ শয্যা রয়েছে ১২৫৯টি। এর মধ্যে রাজধানীর ১৬টি সরকারি হাসপাতালে ৩৯৫টি, ২৭টি বেসরকারি হাসপাতালে ৪৬৬টি।

চট্টগ্রামের ৪টি সরকারি হাসপাতালে ৩৩টি এবং চারটি বেসরকারি হাসপাতালে ২৬টি। সিটি করপোরেশন ব্যতীত ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলা ও উপজেলায় আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৬৩টি। চট্টগ্রাম বিভাগের অন্যান্য জেলা ও উপজেলায় ৪১টি।

ময়মনসিংহ বিভাগে ২২টি, রাজশাহী বিভাগে ৫৮টি, রংপুর বিভাগে ৬৭টি, খুলনা বিভাগে ৬৭টি, বরিশাল বিভাগে ২৮টি এবং সিলেট বিভাগে ২২টি। তবে এসব আইসিইউর মোট কতটি কার্যকর, এর কোনো সঠিক হিসাব নেই অধিদপ্তরে।

বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত আইসিইউ বিশেষজ্ঞরা জানান, একজন মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসায় অবশ্যই কার্যকর আইসিইউ প্রয়োজন। আইসিইউ শুধু একটি শয্যা নয়, রোগীর চিকিৎসায় এর সঙ্গে আরও অনেক যন্ত্রপাতি প্রয়োজন।

কিন্তু বেশির ভাগ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। অনেক আইসিইউতে নেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভেন্টিলেটর সুবিধা।

অনেক আইসিইউতে নেই সিরিঞ্জপাম্প, এবিজি মেশিন বা ডিফেব্রিলেটর। ফলে রোগীকে আইসিইউতে নেওয়া হলেও তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না।

আইসিইউ বিশেষজ্ঞরা জানান, হাসপাতালের সাধারণ শয্যার সঙ্গে আইসিইউ শয্যার পার্থক্য থাকে। কারণ আধুনিক আইসিইউ শয্যগুলো পাঁচটি অংশে প্রয়োজনমতো ওঠানামা করানো যায়।

এছাড়া রোগীর প্রয়োজন অনুসারে শয্যার ওপরের অংশের তাপমাত্রা নিয়িন্ত্রণ করা যায়, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভেন্টিলেটর হলো এমন একটি যন্ত্র, যা একজন রোগীর শারীরিক অবস্থা (মস্তিষ্ক, ফুসফুস) বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন কৃত্রিমভাবে সরবরাহ করে থাকে।

আইসিইউ রোগীদের সুস্থতার জন্য শরীরে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ বিভিন্ন মাত্রায় প্রয়োগ করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্যালাইনের মাধ্যমে এসব ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে নির্দষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ওষুধ দেওয়া যায় না।

এই কাজটি করে সিরিঞ্জ পাম্প বা ইনফিউশন পাম্প। রোগীর শরীরের কফ-কাশি, জমে গেলে, খাদ্য শ্বাসনালিতে প্রবেশ করলে বা বমি হলে সেটি পরিষ্কার করতে সাকশন মেশিন ব্যবহার করতে হয়।

অন্যদিকে রোগীর অ্যাজমা বা হাঁপানির সমস্যা দেখা দিলে নেবুলাইজ করতে হয়। এছাড়া প্রতি ১০ শয্যার জন্য প্রয়োজন একটি করে এবিজি মেশিন, ডিফেব্রিলেটর, ইসিজি মেশিন এবং সেন্ট্রাল মনিটর সিসটেম অবশ্যই রাখতে হবে।

এবিজি-(আর্টিয়াল ব্লাড গ্যাস এনালাইজার) মেশিন দিয়ে রোগীর রক্তে সঠিক মাত্রায় অক্সিজেন যাচ্ছে কি না, সেটি দেখা যায়। পাশাপাশি রোগীর ইলেকট্রোলাইট পরিমাপ করা যায়।

ইসিজি মেশিন দিয়ে রোগীর হৃদ্যন্ত্রের অবস্থা দেখা হয়। এছাড়া রোগীর মারাত্মক অবনতি ঘটলে শক দেওয়ার জন্য ডিফেব্রিলেটর মেশিনের দরকার পড়ে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে ১২৫৯টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। কিন্তু জীবনরক্ষাকারী ভেন্টিলেটর মেশিন রয়েছে ৬৬০টি। অর্থাৎ অর্ধেক শয্যায় এই গুরুত্বপূর্ণ মেশিণটি নেই।

সূত্র জানায়, ২৯৮টি ভেন্টিলেটর মেশিন কোভিড শুরুর আগেই ছিল। দেশে কোভিড-১৯ শুরু হওয়ার পরে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ১০০টি ভেন্টিলেটর দেওয়া হয়।

অধিদপ্তরের হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্টের (এইচএসএম) পক্ষ থেকে ১০০টি কেনা হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে কেনা হয় আরও ১৪৪টি এবং ইউনিসেফের পক্ষ থেকে পাওয়া গেছে আরও ১৮টি।

অর্থাৎ কোভিডকালীন আইসিইউ শয্যা বাড়ানো হলেও সেগুলোকে পরিপূর্ণ রূপ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এছাড়া অনেক বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউতে নামমাত্রই সুবিধা দেওয়া হয়। বেসরকারি পর্যায়ের অনেক হাসপাতালে শুধু শয্যা ছাড়া আর কিছুই থাকে না।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানেসথেসিয়া এনালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. দেবাশিস বণিক বলেন, আইসিইউ সম্পর্কিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন রয়েছে।

কোনো আইসিইউতে যদি সেই গাইডলাইন অনুসারে যন্ত্রপাতি না থাকে, তাহলে সেটাকে আদর্শ আইসিইউ বলা যাবে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, আইসিইউ একটি শয্যা বা একটি নির্দিষ্ট যন্ত্র নয়। এটি একটি চিকিৎসাব্যবস্থা। একটি শয্যার প্রয়োজনীয় যন্ত্রগুলো একটি প্যাকেজের আওতায় কেনা হলে পরিপূর্ণ আইসিইউ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

কিন্তু সরকারের ক্রয় পদ্ধতিতে আইসিইউর প্রতিটি যন্ত্র পৃথকভাবে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে কেনা হয়। ফলে বেশির ভাগ হাসপাতালে পরিপূর্ণ আইসিইউ গড়ে তোলা সম্ভব হয় না।

সামগ্রিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, দেশের সরকারি পর্যায়ের কোভিড আইসিইউগুলোয় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে। তবে বেসরকারি পর্যায়ে অসংগতি থাকতে পারে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে