অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা। শিশুর শরীরে আরবিসি বা লোহিতকণিকার সংখ্যা কমে যায়। এই লোহিতকণিকা ব্রেনে এবং শিশুর সারা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহ করে। অস্থিমজ্জায় নতুন নতুন লোহিতকণিকা উৎপন্ন হয় এবং তা রক্তপ্রবাহ স্রোতে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে তাদের আয়ুষ্কাল হবে ১২০ দিনের।
শিশুর রক্তশূন্যতায় ভোগার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশুরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী।
শিশু রক্তাল্পতায় ভোগে প্রধানত তিন কারণে-
প্রয়োজনমাফিক আরবিসি উৎপন্ন না হয়ে থাকলে
* নবজাতক শিশু উচ্চমাত্রার হিমোগ্লোবিন ও লোহিতকণিকা নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়। তবে দুই মাস বয়সে এসে তা নিচু মাত্রায় চলে আসে। এরপর সিগন্যাল পেয়ে বেশি আরবিসি উৎপাদনের প্রক্রিয়া চলে। এই সময়ের নির্দোষ অ্যানিমিয়া ক্ষতিকর নয়। কোনো ওষুধের চিকিৎসা লাগে না, শুধু মায়ের দুধপানই যথেষ্ট।
* দেহে যখন সুস্থ আরবিসি তৈরি হয় না, তখনও এ সংকট সৃষ্টি হয়; যেমন- আয়রন বা অন্যান্য উপাদানের ঘাটতিজনিত কারণে। দুই বছরের কম বয়সী শিশু এবং বয়ঃসন্ধিকালে শিশু অ্যানিমিয়ার প্রধানত আয়রন ঘাটতিজনিত কারণে হয়ে থাকে। বিশেষ করে কন্যাশিশুর যখন মাসিক শুরু হয়।
* ফলিক এসিড ও বি-১২ ভিটামিনের অভাবে অ্যানিমিয়া হয়। শিশু বয়সের আন্ত্রিক অসুখ সিলিয়াক ডিজিজে ভোগা রোগী এ অবস্থায় পতিত হয়।
* অস্থিমজ্জা যখন রক্তকণিকা তৈরি করতে পারে না, রক্তাল্পতার লক্ষণ নিয়ে সূচিত হয়। এ এক ভয়াবহ অসুখ। এর নাম অ্যাপ্লাসটিক অ্যানিমিয়া। ক্রাইসিস নিয়েও প্রকাশ পেতে পারে। ফ্যানকোনি ও টিইসি- এগুলোও এর অন্য রূপ।
* দীর্ঘমেয়াদি অসুখে ভোগা শিশু রক্তস্বল্পতায় পড়ে। ক্রোনিক কিডনি, হাইপোথাইরয়ডিজম, এডিসনস ডিজিজ, পিটুইটারি গ্রন্থির সমস্যা, যেখানে আরবিসি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় হরমোন মেলে না, এই অসুবিধা নিয়ে আসে। সিসা পয়জনিংয়ের শিকার হলে শিশু রক্তশূন্যতায় ভোগে। হিমোগ্লোবিনের আয়রন অংশজাত হিম তৈরিতে বিষাক্ত সিসা বাধা দেয়।
লোহিতকণিকা যদি ভেঙ্গে যায়
অন্য নাম হিমোলাইটিক অ্যানিমিয়া। নানাবিধ কারণে উৎপন্ন হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে লোহিতকণিকা নষ্ট হয়ে যায়।
* ইনফেকশন, ড্রাগস, সর্প দংশন, বার্ন।
* ক্রোনিক লিভার ডিজিজ। মা বা বাচ্চার ব্লাড গ্রুপে গরমিল আর এইচ রক্ত গ্রুপের প্রতিক্রিয়াজনিত।
* সিকেল সেল অ্যানিমিয়া, থ্যালাসেমিয়া, জি সিক্স পিডির অভাব।
* উচ্চ রক্তচাপ, প্লীহা স্ফীতি।
রক্তপাতজনিত কারণে
* ইনজুরি, বেশি রক্তস্রাব, পাকস্থলী-আন্ত্রিক রক্তপাত।
* কৃমির সংক্রমণ, বিশেষ করে বক্র কৃমি।
* রক্তপাতজনিত অসুখ-হিমোফাইলিয়া।
রোগচিহ্ন
* ফ্যাকাশে ভাব ত্বকে, ঠোঁটে, হাতে-পায়ের তালুতে।
* খিটখিটে মেজাজ, অতিশয় ক্লান্তি, মাথা ঘোরা, বুক ধড়ফড় করা।
কারণ অনুযায়ী অন্যান্য লক্ষণ
আয়রন ঘাটতিজনিত অ্যানিমিয়ায় শিশুর অমনোযোগিতা ও দৈহিক বাড়ন ঠিকমতো না হওয়া লক্ষণ নিয়ে আসতে পারে।
জন্ডিস কালো চা রঙের মূত্র, একটুতেই রক্তপাত সমস্যা প্রভৃতি।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
* সিবিসি, ব্লাড স্মিয়ার। ব্লাড আয়রন লেভেল।
* হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস-থ্যালাসেমিয়াতে।
* বোনম্যারো-অ্যাপ্লাসটিক অ্যানিমিয়া, লিউকেমিয়ায়।
চিকিৎসা
* কারণ অনুযায়ী। আয়রন ঘাটতিজনিত কারণে চিকিৎসক আয়রনসংবলিত ওষুধ লিখে থাকবেন। শিশুর খাবারে আয়রনসমৃদ্ধ আইটেম রাখার পরামর্শ দিতে পারেন। বেশি দুধপান বা দুগ্ধজাত ফর্মুলার ওপর নির্ভরশীল শিশু ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তাই তার পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। ফলিক এসিড বা বি-১২ ভিটামিনের অভাব থাকলে তা দেয়া যেতে পারে।
* গ্রামাঞ্চলে শিশু বয়সে অ্যানিমিয়ার প্রধান কারণ ঘন ঘন কৃমির সংক্রমণ। ১০০ বক্র কৃমি শিশু থেকে প্রতিদিন ৩০ সিসি রক্ত চুষে খায়। সুতরাং, নির্দিষ্ট সময় অন্তর কৃমির ওষুধ খাওয়ানো।