হাত আমাদের শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। নিত্যনৈমিত্তিক কাজগুলো আমরা হাত ছাড়া করতেই পারি না। এই হাতে হতে পারে নানা রকমের ব্যথা। হাতে ব্যথা হলে কী করা উচিত বা কোন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত, এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলো এসকেএফ নিবেদিত স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ অনুষ্ঠান ‘করোনাকালে অসুখ-বিসুখ’–এর সপ্তম পর্বে।
এবারের বিষয় ‘হাতে ব্যথা ও হাতে সমস্যার সার্জারি’। অতিথি হিসেবে ছিলেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটো) সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মহিউদ্দিন। সঞ্চালনায় ছিলেন ডা. শ্রাবণ্য তৌহিদা। অনুষ্ঠানটি ১৮ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল এবং এসকেএফের ফেসবুক পেজ থেকে একযোগে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে হাতের বিভিন্ন রকম সমস্যা নিয়ে প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হয়। হাতের সমস্যা দুই রকম—একটি কনজেনিটাল বা জন্মগতভাবে হাতে কোনো ত্রুটি এবং অন্যটি অ্যাকোয়ারড, অর্থাৎ নিজে যে সমস্যা অর্জন করে। হাতের বেশির ভাগ সমস্যাই অ্যাকোয়ারড। হাতের ভেতরে রয়েছে হাড়, টেন্ডন, নার্ভ বা স্নায়ু, লিগামেন্ট আর আরটারি। হাতের ব্যথা বা সমস্যা হয়ে থাকে এসব অংশের কোনো না কোনো সমস্যার জন্য। যেমন: আঘাতের কারণে হাতের হাড় ভেঙে যাওয়া, টেন্ডন বা লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়া। টেন্ডনে ইনজুরি হলে কেউ সহজে হাত ভাঁজ করতে পারে না। আবার হাতের নার্ভ বা স্নায়ুতে কোনো সমস্যা হলে এর অনুভূতি বা সক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। সে সময় হাত দিয়ে কিছুই করা যায় না। আবার রক্তনালিতে সমস্যা হয়ে হাতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে সম্পূর্ণ হাত অকেজো হয়ে যেতে পারে। হাতের যেকোনো চিকিৎসার জন্য হাতের ভালো সার্জন অথবা কোনো ভালো অর্থোপেডিক চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
হাতের যেকোনো সমস্যাকেই খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। আমাদের দেশে হাতের রগ কাটা খুব সাধারণ একটি সমস্যা। টেন্ডনটাকেই আমরা রগ বলে থাকি। এটি কেটে গেলে হাত নাড়াচাড়া বা ভাঁজ করা যায় না। কোনো আঘাতের পর যদি দেখা যায় কেউ ঠিকমতো হাত ভাঁজ করতে পারছে না বা কোনো আঙুল ভাঁজ করতে পারছে না, সোজা হয়ে আছে, তাহলে বুঝতে হবে ওই আঙুল বা হাতের রগ কেটে গিয়েছে।
কারও রগ কেটে গেলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে, কারণ এর ওপর নির্ভর করে হাত ঠিক হবে কি না। ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে টেন্ডন জোড়া দিতে সার্জারির প্রয়োজন হয়। খুব কম ক্ষেত্রেই ওষুধের মাধ্যমে এটি সেরে যায়। অপারেশনের পর পুরোপুরি বা কত দিনে ঠিক হবে, তা নির্ভর করে রোগীর বয়স এবং আঘাতের কত সময় পর চিকিৎসকের কাছে আনা হলো, তার ওপর।
সাধারণত, হাতের অন্য কোনো ফ্র্যাকচারের পর চিকিৎসকেরা হাতটিকে বিশ্রাম দিতে বলেন। কিন্তু রগ বা টেন্ডনের সার্জারি যেদিন হবে, তার পরের দিন থেকেই আস্তে আস্তে নাড়াচাড়া করার পরামর্শ দেওয়া হয়। একেক টেন্ডন ইনজুরির জন্য রয়েছে একেক রকমের নাড়াচাড়ার নিয়ম। যেমন হাতের সামনের অংশে টেন্ডন কেটে গেলে অন্য হাত দিয়ে সে হাত ভাঁজ করতে হবে এবং পরে একা একা সেই ভাঁজ খোলার চেষ্টা করতে হবে। এসব প্রটোকল না মানলে রগ জোড়া লাগলেও হাত ‘স্টিফ’ হয়ে যেতে পারে। এ কারণে রোগী সারা জীবনের জন্য হাত নাড়াচাড়া করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। এ জন্য সার্জারির পর রোগীর উচিত হবে চিকিৎসকের পরামর্শ পুরোপুরি মেনে চলা।
এ ধরনের চিকিৎসায় রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে যোগাযোগ ভালো হতে হবে। সার্জারির পরের প্রটোকলগুলো রোগী ঠিকমতো বুঝতে পেরেছে কি না এবং সেই অনুযায়ী চলছেন কি না, এ ব্যাপারগুলো চিকিৎসকেও নিশ্চিত হতে হবে। রোগী যদি বুঝতে না পারে বা ঠিকমতো কথা না শোনে, তাহলে সেটি ধৈর্যসহকারে বারবার বোঝানো চিকিৎসকের দায়িত্ব।
হাতের যেকোনো আঘাতজনিত ব্যথার সঙ্গে প্লাস্টারের চিকিৎসা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কোনো রোগীকে প্লাস্টার দিতে গেলে চিকিৎসককে সতর্কতা অবলম্বন করতেই হবে। নিজের ইচ্ছেমতো প্লাস্টার বাঁধা যায় না। হাত বা পায়ের কোনো আঘাতে প্লাস্টারের দরকার হলে অবশ্যই সঠিক মাপজোখ করে তা লাগাতে হবে। একটু ঢিলা বা খুব বেশি টাইট হলে চলবে না। ঢিলা হলে সেই প্লাস্টারটি কোনো কাজেই আসে না। আর খুব বেশি টাইট হলে হাতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পরে দেখা গেল হাতটি পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেছে। এ ধরনের সমস্যা হলে শেষ পর্যন্ত হাত কেটে ফেলা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। তাই প্লাস্টার করার সময় চিকিৎসকের সর্বোচ্চ সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই।
অনেকে হাতে কোনো ব্যথা পেলে কবিরাজের কাছে চলে যায়। পরে হাত ঠিক না হলে একদম শেষে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। ব্যথা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে এলে যে ফলটা পাওয়া যেত, তা অনেক দেরি করে গেলে পাওয়া মোটেও সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে সবাইকে বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে। আমাদের দেশেই সরকারি হাসপাতালগুলোয় এখন স্বল্প খরচে নানা রকমের অর্থোপেডিক চিকিৎসা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
অনুষ্ঠানের শেষ দিকে ডা. মো. মহিউদ্দিন দর্শকদের হাতে ব্যথা–সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
সূত্রঃ প্রথম আলো