মরণোত্তর অঙ্গদানে এগিয়ে আসুন

0
390
abm abdullah
Spread the love

একজন মানুষ তার মৃত্যুর পর দেহের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অঙ্গ যেমন: কিডনি, হৃৎপিণ্ড, লিভার, ফুসফুস, চোখ, এমনকি সম্পূর্ণ শরীর দান করতে পারেন। মারা যাওয়ার পর ওই মৃত ব্যক্তির দান করা অঙ্গ প্রতিস্থাপন করে বেঁচে থাকতে পারে অঙ্গ অকার্যকর হওয়া অন্য রোগী।

এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় মরণোত্তর অঙ্গদান বা ক্যাডাভারিক অরগান ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করা ব্যক্তির দুটি কিডনি দুজনকে, একটি লিভার একজনকে একটি ফুসফুস একজনের এবং একটি হৃৎপিণ্ড একজনের দেহে প্রতিস্থাপন করে ভিন্ন ভিন্ন পাঁচজন রোগীকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব। চোখের কর্নিয়া দানের মাধ্যমে অন্ধলোক দৃষ্টি ফিরে পেতে পারে। এছাড়া সম্পূর্ণ শরীর মেডিকেল কলেজে দান করলে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে শিক্ষা এবং গবেষণা করতে পারবে।

অঙ্গদান প্রক্রিয়ায় মানুষ অঙ্গদান করবেন এবং তার মৃত্যুর পর সেই অঙ্গটি সংগ্রহ করে তা প্রতিস্থাপিত করা হবে এমন রোগীর দেহে, যার অকার্যকর হওয়া অঙ্গের প্রয়োজন। উন্নত দেশে মরণোত্তর প্রক্রিয়ায় অঙ্গ নিয়ে বেঁচে আছেন অনেক মানুষ। অথচ ধর্মীয় বা প্রচলিত আইনে বাধা না থাকলেও কর্নিয়া সংযোজন ছাড়া দেশে শুরু হয়নি অন্য কোনো অঙ্গ মরণোত্তর প্রক্রিয়ায় প্রতিস্থাপন।

একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। অনেকদিন আগের কথা, একজন জ্ঞানী ব্যক্তি মারা যাওয়ার আগে উইল করে গেছেন, আমার মৃত্যুর পর চোখ, অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং পুরো শরীরটা দান করে গেলাম। কোনো রোগীর অকার্যকর অঙ্গের প্রয়োজন হলে আমার সেই অঙ্গ নিয়ে তার শরীরে প্রতিস্থাপন করতে পারবে। এমনকি আমার শরীরটা মেডিকেল কলেজে ডিসেকশন হলে যেন দিয়ে দেওয়া হয়।

মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা আমার শরীর চিকিৎসাবিদ্যায় জ্ঞান অর্জনের এবং গবেষণা কাজে ব্যবহার করতে পারবে। ওই সময় জানা গেল, কোনো এক রোগীর দুটি চোখ অন্ধ, তার চোখের কর্নিয়া ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা দরকার। কিন্তু কোনো ডোনার পাওয়া যাচ্ছিল না। উইল করা লোকটি মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খবর পেয়ে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ওই মৃত ব্যক্তির চোখ দুটো উঠিয়ে নিলেন।

সিদ্ধান্ত হলো তার চোখের কর্নিয়া অন্ধ লোকটির চোখে প্রতিস্থাপন করা হবে। মরণোত্তর চক্ষুদানকারী ওই লোকের পরিচয় রোগী এবং তার পরিবারকে জানানো হলো। বাদ সাধল রোগী নিজেই, যখন তিনি জানতে পারলেন চক্ষুদানকারী ব্যক্তি নাস্তিক ছিলেন। রোগী ধর্মভীরু ছিলেন। নাস্তিকের দান করা চোখ নিতে তিনি অস্বীকৃতি জানালেন। পরে তাকে অনেক বোঝানো হলো যে শরীরের একটা অঙ্গ ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা কোনোক্রমেই ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।

দানকারীর কর্নিয়া আপনার চোখে প্রতিস্থাপন করলে দৃষ্টি ফিরে পাবেন। আপনি ভালো থাকবেন, আপনার পরিবার ভালো থাকবে, এমনকি ভবিষ্যতে দেশের এবং দশের অনেক উপকারও করতে পারবেন। শেষ পর্যন্ত রোগী রাজি হলেন, কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের পর তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন।

আরও একটা ঘটনা বলি। একজন বয়স্ক মহিলা, তার দুটো কিডনিই সম্পূর্ণ অকার্যকর। ছেলে-মেয়েরা অনেক চেষ্টা করেও দেশে-বিদেশে কোনো ডোনার পাচ্ছিলেন না। উনি বিদেশে থাকেন, হঠাৎ হাসপাতাল থেকে ফোন করা হলো তার ছেলের কাছে, আপনার মায়ের কিডনি নষ্ট? যদি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে চান এখনই হাসপাতলে নিয়ে আসুন, একজন ডোনার পাওয়া গেছে।

সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলো, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার একটি কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হলো। রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে নতুন জীবন পেয়ে বাড়ি ফিরলেন। তার বয়স এখন ৯০ বছর। যিনি কিডনি দান করেছেন, উনি ছিলেন একজন এক্সিডেন্টের রোগী, আইসিইউতে মারা যান। তার ভ্যানিটি ব্যাগে ছিল ডোনার কার্ড, সেখানে লেখা ছিল আমার মৃত্যুর পর শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করে গেলাম, জীবিত রোগীদের, যার যে অঙ্গ প্রয়োজন, তাকে যেন তা দিয়ে দেওয়া হয়।

আরও একজন মহিলার গল্প বলছি। তিনি মারা যাওয়ার আগে উইল করে গেছেন, আমার মৃত্যুর পরে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করে গেলাম, যা জীবিত বিকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের রোগীকে প্রতিস্থাপন করতে পারবেন। মহিলার কোনো একটি অপারেশনের সময়েই ব্রেন ডেথ হয়। পরিবারের সম্মতিতে তার লিভার ও দুটি কিডনি প্রতিস্থাপিত করা হয় তিনজন রোগীর শরীরে এবং তারা সবাই সুস্থ হয়ে উঠেন। তবে আমাদের সমাজে অন্য চিন্তাধারার লোকও রয়েছে।

আরও একটি অদ্ভুত গল্পের কথা বলছি। এক ভদ্রলোক মারা যাওয়ার আগে উইল করে গেছেন, আমার মৃত্যুর পর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করে গেলাম, তবে কোনো চোর, ডাকাত বা অসৎ লোকের শরীরে ওই অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো যেন প্রতিস্থাপন করা না হয়। কারণ আমার অঙ্গ প্রতিস্থাপন করে অপকর্ম করার সুযোগ কাউকে দিতে চাই না।

মানুষের অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গের ক্ষমতা নষ্ট হলে মৃত্যু অবধারিত। তখন বিকল্প উপায় হচ্ছে অঙ্গ প্রতিস্থাপন। বাংলাদেশে শুধু রক্তসম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে কিডনি ও লিভার সংযোজন হচ্ছে। জীবিত মানুষ দুটি কিডনি থেকে একটি এবং লিভারের কিছু অংশ দান করতে পারেন। মৃত মানুষের শরীর থেকে প্রায় সব অঙ্গই প্রতিস্থাপনের জন্য সংগ্রহ করা যায়। লাখ লাখ মানুষ শরীরের কোনো কোনো অঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়ার রোগে ভোগেন এবং তার একমাত্র চিকিৎসা অঙ্গ প্রতিস্থাপন। তাই যত বেশিসংখ্যক মানুষ মরণোত্তর অঙ্গদান করবেন, তত বেশিসংখ্যক রোগীর জীবন রক্ষা পাবে।

মরণোত্তর অঙ্গদানের অগ্রগতি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে খুব একটা দৃশ্যমান নয়। মৃত্যুর পরে অঙ্গদান করা অনেকের কাছে শোভনীয় মনে হয় না। ব্যাপারটি অত্যন্ত জটিল। এখানে ধর্মীয়, পারিবারিক, সামাজিক অনেক কিছু জড়িত। এ কথা সত্য, মানুষ মারা গেলে তার দেহ কোনো কাজে আসে না। কবরে তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সবকিছুই মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। পুড়িয়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে ছাই হয়ে যাবে।

যদি মৃত্যুর পর তার দেহের কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রোগাক্রান্ত মানুষের জন্য ব্যবহার করা যায, সেটা বড় অবদান বলেই মনে হয়। মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির আত্মা তো আল্লাহর কাছেই চলে যায়। শরীরের আর কীই বা মূল্য থাকে। কিন্তু এর দ্বারা যদি অপর একজন সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে সক্ষম হন, তবে তার চেয়ে পুণ্যের কাজ আর কী হতে পারে? এ ধরনের চিন্তাভাবনা আমাদের মাঝে অনেকেরই নেই। মানুষ অঙ্গদানে ভয় পান। এতে ডোনার বা দাতার সংকট দেখা দিচ্ছে প্রকট আকারে।

মনে রাখতে হবে, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হলে শরীরের অন্য অঙ্গেও রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। সেগুলো দ্রুত বিকল হয়ে পড়ে। আর ব্রেন ডেথ হলে যার বেঁচে থাকার কোনো সম্ভাবনাই নেই, তার অঙ্গ নিয়ে অন্য রোগীর ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা সম্ভব। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে হাসপাতালের সহায়তায় হৃদযন্ত্রের কাজ চালু রাখতে হবে। দেশে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় প্রচুর মানুষ মারা যাচ্ছে। আইসিইউতে মুমূর্ষু অবস্থায় থাকা কোনো রোগী যার বাঁচার সম্ভাবনা নেই, তাকে ব্রেন ডেথ ঘোষণা করার পর তার দেহ থেকে অঙ্গ নিয়ে সেটি প্রতিস্থাপন করে আলাদাভাবে পাঁচজন অঙ্গ বিকল মানুষকে বাঁচানো যায়।

তবে এটা এমন নয় যে, কারও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিল অথচ তার দেহ থেকে অঙ্গ নিয়ে মেরে ফেলা হলো। মানবদেহে মরণোত্তর অঙ্গ সংযোজন আইনে এ কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, মেডিসিন অথবা ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন, নিউরোলজি এবং অ্যানেসথেসিওলজি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অথবা সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদার অন্তত তিনজন চিকিৎসকের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি কোনো ব্যক্তির ব্রেন ডেথ ঘোষণা করতে পারবেন। এরপরই ওই ব্যক্তির দেহ থেকে অঙ্গ বিযুক্ত করার কাজটি করা যাবে।

উন্নত বিশ্বে কিডনি বিকল অনেক মানুষ মরণোত্তর অঙ্গদান প্রক্রিয়ায় চিকিৎসা নিয়ে নতুন জীবন ফিরে পাচ্ছে। আর বাংলাদেশে শুধু দাতা সংকটের কারণে বছরে মারা যাচ্ছে ৪০ হাজার কিডনি রোগী। একইভাবে হাজার হাজার মানুষ লিভার, হৃদযন্ত্র, ফুসফুস, অগ্ন্যাশয় ইত্যাদি রোগে মারা যাচ্ছে।

বাংলাদেশে ২০১৮ সালের মানবদেহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনমতে ব্যক্তির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অন্যের শরীরে সংযোজনের সুযোগ রাখা হয়েছে। আইনে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বলতে কিডনি, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, অন্ত্র, লিভার, অগ্ন্যাশয়, অস্থি, অস্থিমজ্জা, চোখ, চর্ম, টিস্যুসহ মানবদেহে সংযোজনযোগ্য যে কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে বোঝানো হয়েছে। বাস্তবে ক্যাডাভারিক অরগান ট্রান্সপ্ল্যান্ট প্রক্রিয়া অধরাই থেকে যাচ্ছে। অথচ ধর্ম কিংবা বিদ্যমান আইনে মরণোত্তর অঙ্গদানে কোনো বাধা নেই। মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সংস্থা ওআইসি এবং বিশিষ্ট ইসলামিক ওলামারা মরণোত্তর কিডনিসহ অন্যান্য অঙ্গদানকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

অঙ্গদান নিয়ে মানুষের মাঝে একটা আবেগ কাজ করে। প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছি। এখন মানবিকভাবে আরও এগিয়ে যেতে হবে। ক্ষণস্থায়ী জীবনে আমাদের সবার উচিত ভালো কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা, যা কিছু কল্যাণকর, তা-ই ধর্মের অন্যতম শিক্ষা। ধর্ম একে অপরের প্রতি দয়া-মায়া ও ভালোবাসতে শেখায়। একজন মানুষ যে ধর্মের অনুসারীই হোক, কোনোভাবেই সে যেন একে অপরের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, বরং কল্যাণ লাভ করে-এটাই ধর্মের শিক্ষা।

মরণোত্তর অঙ্গদান কার্যক্রম সফল করতে সবার আগে দরকার সামাজিক সচেতনতা। মরণোত্তর অঙ্গদান কঠিন কাজ মনে হলেও অসম্ভব কিন্তু নয়। বিপুলসংখ্যক মানুষের মধ্যে এই বোধ ও চেতনা জাগ্রত হওয়া দরকার। আসুন আমরা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকার্যকর হওয়া রোগীদের পাশে থাকি। এ দেশে এই চিকিৎসা চালু হলে অকালে হারাতে হবে না অনেক জীবন। তাই মরণোত্তর অঙ্গ বা দেহদান এমনই একটি কল্যাণকর কাজ। মোমবাতি যেমন জ্বলতে জ্বলতে সবাইকে আলো দিয়ে নিজে নিভে যায়, আমাদের জীবন প্রদীপ নিভে গেলেও অন্যকে আলো দিয়ে যাওয়া উচিত।

অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ, (প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে