বিশ্বে ৮৫ কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত এবং সে হিসাবে প্রতি ১০ জনে একজন কিডনি রোগে আক্রান্ত। আর দেশের দুই কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে আক্রান্ত। প্রতিবছর চার লাখ মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে কিডনি রোগে। প্রাণঘাতী এই রোগ থেকে দূরে থাকতে হলে সচেতন হতে হবে সবাইকে।
প্রতিবছর মার্চ মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার কিডনিজনিত রোগ প্রতিরোধ এবং এর ঝুঁকিবিষয়ক সচেতনতা সম্পর্কে জনগণকে অধিক সচেতন ও শিক্ষিত করতে বিশ্বজুড়ে কিডনি দিবস পালন করা হয়। এই বছর বিশ্ব কিডনি দিবস ২০২২-এর প্রতিপাদ্য হলো ‘সুস্থ কিডনি সবার জন্য’, যার লক্ষ্য কিডনিজনিত রোগের লক্ষণগুলো সম্পর্কে শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি এবং তা নিরাময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কে জানানো। এ জন্য এই বছরে কিডনি রোগ থেকে বাঁচতে ছয়টি স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে।
♦ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
♦ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
♦চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করুন।
♦পরিমিত শরীরচর্চা করুন।
♦ধূমপান ও মদ্যপান থেকে দূরে থাকুন।
♦ফলমূল ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন।
করোনা মহামারির মতো প্রতিদিনই বাড়ছে এই কিডনি রোগীর সংখ্যা। অন্য একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি সাতজনে একজন কিডনি রোগী। শতকরা ৮৫ ভাগ রোগীর কিডনি নষ্ট হওয়ার আগে বুঝতে পারে না যে তারা কিডনিজনিত রোগে আক্রান্ত। নেফ্রাইটিস, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ এবং প্রস্রাবজনিত সমস্যায় আমাদের দেশে শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ লোকের কিডনি ধীরে ধীরে বিকল হয়ে যাচ্ছে।
কিডনি কী?
কিডনি হলো রক্ত পরিশোধনের শোধনাগার, যা রক্ত পরিষ্কার করার কর্মীর মতো কাজ করে। খাদ্য গ্রহণ ও কাজ করার ফলে শরীরের যে অসংখ্য ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটে, তার ফলে অনেক ধরনের বর্জ্য পদার্থ শরীরে তৈরি হয়। আর বেঁচে থাকার তাগিদে অপ্রয়োজনীয় অংশ শরীর থেকে বের করে দিতে হয়। মানুষের শরীর থেকে এসব বর্জ্য পদার্থ বের করার মাধ্যম হলো চারটি—কিডনি, রেসপিরেটরি সিস্টেম, চামড়া ও মুখ-খাদ্যনালি-পায়ুপথ। কিডনি তার প্রতিটি কিডনিতে থাকা ১০ লাখ রক্ত ছাঁকনি বা নেফ্রন দিয়ে ছেঁকে প্রয়োজনীয় পদার্থ রেখে দেয় এবং প্রোটিন মেটাবলিজমের কারণে তৈরি নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য পদার্থ; যেমন—ইউরিয়া, ইউরিক এসিড, ক্রিয়েটিনিন ও অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় পদার্থ প্রস্রাবের সঙ্গে শরীর থেকে বের করে দেয়।
কিডনি রোগ
মানুষ দুই ধরনের রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়। একটি হলো সংক্রামক এবং অপরটি হলো অসংক্রামক। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ অসংক্রামক রোগ দ্বারাই বেশি আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
কিডনির বিভিন্ন ধরনের রোগ রয়েছে; যেমন—কিডনিতে আঘাত, ক্রনিক কিডনি রোগ (সিকেডি) রেনাল স্টোনস, নেফ্রোটিক সিনড্রোম, গ্লোমারিউলোনেফ্রিটিস, রেনাল সেল কারসিনোমা, মূত্রনালির সংক্রমণ, জন্মগতভাবে বা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া কিডনি রোগ ইত্যাদি।
কিডনি বিকল হয় কেন?
কিডনি বিকলতার নানা রকম কারণের মধ্যে কিডনি টিস্যুর প্রদাহ, নিয়ন্ত্রণহীন দীর্ঘমেয়াদি ডায়াবেটিস, নিয়ন্ত্রণহীন দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান ও মাদকদ্রব্যে আসক্তি, অনিয়ন্ত্রিত লাইফস্টাইল, জন্মগত ত্রুটি, জেনেটিক ও পারিবারিক ধারার অসুখ প্রভৃতি।
ক্রনিক কিডনি ডিজিজ
ক্রনিক কিডনি ডিজিজ একটি স্থায়ী ও প্রগ্রেসিভ ডিজিজ। কিডনিতে একবার ড্যামেজ প্রক্রিয়া শুরু হলে তা ধীরে ধীরে এবং অব্যাহতভাবে আমৃত্যু চলতেই থাকবে। ওষুধ বা অন্য কোনো উপায়ে এই ড্যামেজ প্রক্রিয়া একেবারে বন্ধ করে দেওয়ার কোনো উপায় নেই। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসা-পরামর্শে ড্যামেজ প্রক্রিয়া ধীর করা যায়।
ক্রনিক কিডনি রোগের প্রাথমিক পর্যায়
♦যখন কিডনি ড্যামেজ প্রক্রিয়া একনাগাড়ে তিন মাসের বেশি অব্যাহত থাকবে।
♦যখন দেখবেন আপনার জিএফআর বা সিরাম ক্রিয়েটিনিন লেভেল নরমাল; কিন্তু বায়োপসি টেস্টে হিস্টোলজিক অ্যাবনরমালিটি তথা কিডনির ড্যামেজ প্রক্রিয়া ধরা পড়েছে।
♦যখন দেখবেন জিএফআর লেভেল ৬০ মিলিলিটার/মিনিটের নিচে অব্যাহতভাবে তিন মাস থাকবে অথচ বায়োপসি টেস্টে কোনো হিস্টোলজিক অ্যাবনরমালিটি নেই।
ক্রনিক কিডনি রোগ যখন প্রগ্রেসিভ পর্যায়ে
ক্রনিক কিডনি ডিজিজ একটু ধীরে ধীরে; কিন্তু স্থায়ীভাবে দুটি কিডনিই একসঙ্গে বিকল হওয়া রোগকে বলা হয় প্রগ্রেসিভ ডিজিজ, যার বিকলপ্রক্রিয়া একবার শুরু হলে সম্পূর্ণ বিকল না হওয়া পর্যন্ত কোনো ওষুধ দিয়েও তা থামানো যায় না। তবে এ রোগের চিকিৎসায় কিডনি বিকল হওয়ার গতি কমিয়ে আনা যায়; কিন্তু বিকল হওয়া একেবারে থামিয়ে দেওয়া যায় না। এর কারণ হলো আমাদের প্রতি কিডনিতে যে অন্তত ১০ লাখ নেফ্রন তথা ছাঁকনি থাকে, তা একবার স্থায়ী ড্যামেজ প্রক্রিয়ায় মরে গেলে পড়ে তা আর জীবিত হয় না; বরং এগুলোর পাশে থাকা অন্য নেফ্রনগুলোকেও ক্রমাগতভাবে ধীরে ধীরে ধ্বংসের প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসে।
সিকেডি
প্রায়ই প্রাথমিক পর্যায়ে, এমনকি দুটি কিডনির কার্যক্ষমতা ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ার পরও মানুষ বুঝতে পারে না যে তার কত বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে। লক্ষণ দৃশ্যমান না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো কিডনির অভিযোজনক্ষমতা বা রিজার্ভ পাওয়ার অনেক বেশি। সাধারণত কিডনির কার্যক্ষমতা ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ না কমা পর্যন্ত রক্ত পরীক্ষায় সিরাম ক্রিয়েটিনিন লেভেল উচ্চ দেখায় না। আবার সাধারণত সিরাম ক্রিয়েটিনিন লেভেল দুই না হওয়া পর্যন্ত আলট্রাসনোগ্রাফিতেও ভালোমতো বোঝা যায় না যে ব্যক্তির ক্রনিক কিডনি ডিজিজ হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে কিডনিতে ক্ষতি যখন অপরিবর্তনীয় হয়ে যায়, তখন রোগীও বেশ কয়েকটি লক্ষণ অনুভব করতে পারে; যেমন—গোড়ালি ও পা ফোলা, ওজন হ্রাস, ক্ষুধামান্দ্য, রক্তশূন্যতা হয়ে ফ্যাকাসে দেখানো, শারীরিক দুর্বলতা, প্রস্রাবে সমস্যা ইত্যাদি।
সুতরাং সিকেডি একটি নীরব ঘাতক রোগ, যা ক্যান্সারের চেয়েও ভয়াবহ। কারণ অনেক ক্যান্সারই সময়মতো চিকিৎসায় ভালো হয়; কিন্তু সিকেডি রোগটি শুরু হয় অনেকটাই নীরবে এবং যার শেষ রক্ষা হিসেবে করতে হয় ডায়ালিসিস অথবা কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন এবং পরবর্তী সময়ে শেষ পরিণতি মৃত্যু।
সুতরাং এই প্রাণঘাতী রোগ থেকে বাঁচার মূল চেষ্টা রোগের চিকিৎসা করার চেয়ে রোগ যাতে না হতে পারে সে ব্যবস্থা করা। যদি কেউ এমন কোনো লক্ষণ অনুভব করেন, যা কিডনি রোগের ইঙ্গিত দেয়, তবে তাঁদের তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
লেখক :
ডা. মো. তৌহিদ হোসাইন, সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডিপার্টমেন্ট অব হিস্টোপ্যাথলজি,ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি, শেরেবাংলানগর, ঢাকা।