ঘুমের মধ্যে হাত-পা ছুঁড়ছেন, কথা বলছেন বা চিৎকার করছেন – এ ধরনের আজগুবি কোনও কাজ করলে, তখন বুঝতে হবে আপনার শরীর পারকিনসন্স রোগের পূর্বাভাস দিচ্ছে। কোন পূর্বাভাস পেলে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসায় এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
চিকিৎসকদের মতে, বাংলাদেশে পারকিনসন্স রোগ সম্পর্কে মানুষের ধারণা সেভাবে নেই। ফলে সচেতনতাও গড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে বাংলাদেশে পারকিনসন্স রোগের পরিস্থিতি নিয়ে কোনও গবেষণা কখনও হয়নি। কিন্তু স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারকিনসন্স রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
পারকিনসন্স রোগ কী?
মস্তিস্কে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থের ঘাটতির কারণে এই রোগ দেখা দেয়। ব্রেন এর মধ্যে ছোট একটা অংশ রয়েছে, যেটিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ‘সাবস্ট্যানশিয়া নাইগ্রা’ বলা হয়।
এই অংশের স্নায়ু কোষ বা নিউরোন শুকিয়ে যাওয়ার কারণে ডোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার (এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ) নষ্ট হয়ে যায় অথবা এর ঘাটতি দেখা দেয়।
স্বাভাবিক অবস্থায় মস্তিস্কে ব্যাজাল গ্যাংলিয়া নামের একটি অংশ মানুষের চলাফেরা এবং গতির সমন্বয় করে থাকে, ডোপামিনের অভাবে সেই সমন্বয়ের প্রক্রিয়া নষ্ট হয়ে যায়। তখন একজন মানুষ আক্রান্ত হয় পারকিনসন্স রোগে।
বাংলাদেশে কতটা উদ্বেগের
দেশে যেহেতু কোন গবেষণা নেই, সেকারণে পারকিনসন্স রোগীর কোনও পরিসংখ্যান সংশ্লিষ্ট কেউ বলতে পারে না। তবে চিকিৎসকদের মতে, এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
ঢাকায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল এর একজন চিকিৎসক হুমায়ুন কবির হিমু তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, স্নায়ুর নানা সমস্যা নিয়ে আসা ৪০ জন রোগী যদি তিনি দেখেন, তার মধ্যে গড়ে কমপক্ষে পাঁচজন থাকে পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত। এই সংখ্যাটাকে তিনি উদ্বেজনক বলে মনে করেন।
কারণ জানা নেই
চিকিৎসক হুমায়ুন কবির হিমু জানিয়েছেন, পারকিনসন্স রোগীদের প্রায় ৮৫ শতাংশের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণ জানা যায় না। পাঁচ শতাংশের ক্ষেত্রে জিনগত কারণ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়।অর্থাৎ পূর্বপুরুষের কেউ এই রোগে আক্রান্ত ছিল, তার কাছ থেকে রোগটি এসেছে। এছাড়া দশ শতাংশের মধ্যে পারকিসন্সের লক্ষণ প্রবল থাকে। সেটিকে পারকিনসনিজম বলা হয়।
এটি সাধারণত স্ট্রোক, মস্তিস্কে সংক্রমণ, মস্তিস্কে আঘাত এবং উইলসন ডিজিজ-এ ধরনের রোগের ক্ষেত্রে পারকিনসনিজম হয়। তবে কয়েকবছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউটের একদল বিজ্ঞানী গবেষণা চালিয়ে বলেছেন, মানুষের পেটের ভেতরে পরিপাক নালীতে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থেকে এই রোগের সৃষ্টি হতে পারে। তারা দেখেছেন, এসব ব্যাকটেরিয়া থেকে কিছু রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়, যা মস্তিস্কের কিছু অংশকে অত্যন্ত উদ্দীপ্ত করে তোলে।
সেকারণে মস্তিস্কের ওই অংশের মারাত্নক ক্ষতি হতে পারে। এর ফলে মস্তিস্কের একটা অংশ ঠিকমতো কাজ বন্ধ করে দেয় এবং এসব স্নায়ুকোষের মৃত্যু হয়। আর এই পরিস্থিতিতে শরীরে যে অবস্থা হয়, সেটাকে পারকিনসন্স বলেছেন ক্যালিফোর্নিয়ার ঐ গবেষকরা।
পারকিনসন্স এর লক্ষণ
এই রোগে আক্রান্ত হলে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপসর্গ দৃশ্যমান হয়।
১. হাত এবং পায়ে কাঁপুনি হয়।
২. শরীরের একপাশের হাত এবং পা স্বাভাবিকের তুলনায় শক্ত হয়ে যায়।
৩. চলাফেরার গতি ধীর হয়ে যায়।
আরও কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে:
৪. কেউ আক্রান্ত হলে শরীরের ভারসাম্য ধরে রাখতে না পারায় সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটতে দেখা যাবে।
৫. কণ্ঠ বা কথার স্বর নীচু হতে পারে বা কমে যেতে পারে।
৬. এমনকি চোখের পাতার নড়াচড়াও কমে যেতে পারে।
৭. শরীরের ভারসাম্য ধরে রাখতে সমস্যা হওয়ায় আক্রাত ব্যক্তি বারবার পড়ে যেতে পারেন।
৮. এছাড়া হতাশা, উদ্বেগ, উদাসীনতা ঘুম কমে যাওয়া- এধরনের লক্ষণ যেমন দেখা দেয়।
৯. কোষ্ঠ কাঠিন্য এবং প্রস্রাব আটকে যাওয়ার মতো সমস্যাও হয়ে থাকে।
পূর্বাভাস মিলবে ঘুমের মধ্যে
প্রাথমিক পূর্বাভাসের ব্যাপারে ডেনমার্কের আরহাস ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণা রয়েছে। সেই গবেষণায় জানা যায়, ঘুমের মধ্যে র্যাপিড আই মুভমেন্ট বা আরবিডি হতে পারে। কেউ এই আরবিডি’র শিকার হলে তিনি ঘুমের মধ্যে হঠাৎ বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে বসতে পারেন।
এছাড়া ঘুমের মধ্যে হাত-পা ছোঁড়া, কথা বলা অথবা চিৎকার করা-এ ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। কারণ আরবিডি’র শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মস্তিস্কে রক্ত সঞ্চলনে ভিন্নতা দেখা দেয় এবং সে কারণে মস্তিস্কের কোষে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছায় না।
চিকিৎসকরা বলেন, স্বাভাবিকভাবে ঘুম যখন গভীর হয়, তখন শরীর সাময়িকভাবে প্যারালাইজড বা অবশ হয়ে গেলেও মস্তিস্ক সজাগ মানুষের মত সক্রিয় থাকে। কিন্তু আরবিডি’তে যারা ভোগেন, তাদের শরীর ঘুমের মধ্যে অস্বাভাবিকভাবে অবশ হয়ে যায় এবং সেজন্য তারা স্বপ্নে যা দেখে তা বাস্তবেও করতে থাকে। এসব উপসর্গকে পারকিনসন্স রোগ দেখা দেয়ার প্রাথমিক পূর্বাভাস হিসেবে ধরা হয়।
পারকিনসন্স বেশি হয় কাদের?
এই রোগ পুরুষদের বেশি হয়। ৫০ এর বেশি বয়সীদের এই রোগ হওয়ার সম্ভবনা বেশি থাকে। তবে জেনেটিক কারণে হলে অনেক কম বয়সে ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সেও এই রোগ হতে পারে।
এর গতিধারা কেমন
স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞরা পারকিনসন্স রোগের গতিধারাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন।
পর্যায় এক:
একেবারে প্রাথামিক অবস্থায়, যাকে মৃদু পর্যায় বলা হয়। এই অবস্থায় শরীরে একপাশে হাল্কা অবশ অনুভূতি ছাড়া সেভাবে লক্ষণ প্রকাশ পায় না।
পর্যায় দুই:
মুখের অভিব্যক্তি কিছুটা পরিবর্তন হয় অর্থ্যাৎ হাসি-কান্নার মতো অভিব্যক্তি কমে যায়। শরীরের একপাশে হাত-পায়ে কাঁপুনি প্রকাশ পায়।
পর্যায় তিন:
এই পর্যায় রোগীর উপসর্গগুলো দ্রুত দৃশ্যমান হয়। রোগীর শরীর ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। ফলে চলাফেরা করতে রোগীর বারবার পড়ে যান। অবশ্য এই রোগী কোনও সাহায্য ছাড়া নিজে নিজের কর্মকাণ্ড চালাতে পারেন।
পর্যায় চার:
চতুর্থ পর্যায়ে এসে রোগী কোনও সাহায্য ছাড়া দাঁড়াতে পারেন না। রোগীর বিভিন্ন পেশী শক্ত হয়ে যায় এবং নড়াচড়া করতে সমস্যা হয়। ফলে রোগীকে একা রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
পর্যায় পাঁচ:
রোগী শেষ পর্যায়ে চলে এসেছেন বলা হয়। এই পর্যায়ে রোগী নিজে কিছুই করতে পারেন না। তখন রোগীকে হুইলচেয়ারে রাখতে হয় অথবা তিনি একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন।
এছাড়া চিকিৎসকরা বলছেন, পারকিনসন্স রোগে ভুগলে একপর্যায়ে গিয়ে কিছুটা স্মৃতিভ্রম হতে পারে। তবে স্মৃতিভ্রম অর্থাৎ ভুলে যাওয়া বা ডিমেনশিয়া সম্পূর্ণ আলাদা রোগ।
বাংলাদেশে চিকিৎসা কতটা আছে
চিকিৎসক হুমায়ুন কবির হিমু জানিয়েছেন, বাংলাদেশে এই রোগ শণাক্ত করার ব্যবস্থা এবং যথাযথ চিকিৎসা রয়েছে। এখন সারাদেশেই স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন এবং মেডিসিন বিশেষজ্ঞরাও এই রোগের চিকিৎসা করতে পারেন। এর পূর্বাভাস পেলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই চিকিৎসক অবশ্য বলেছেন, পারকিনসন্স হলে পুরোপুরি নিরাময় করা সম্ভব নয় বা নিরাময়যোগ্য নয়।
কিন্তু ডায়াবেটিস হলে যেমন সারাজীবন চিকিৎসকের পরামর্শে এক ধরনের শৃঙ্খল জীবন যাপন করতে হয়। পারকিনসন্স রোগের ক্ষেত্রেও চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেয়ে তা নিয়ন্ত্রণে রেখে দীর্ঘসময় ভাল থাকা বা স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব। যেহেতু এই রোগে সারাজীবন ওষুধের ওপর নির্ভর করতে হয়, সেজন্য ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও হতে পারে। সেকারণে এই রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হয়।
অপারেশনের চিকিৎসাও আছে
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ডিপ ব্রেন স্টিম্যুলেশন বা ডিবিএস পদ্ধতিতে অতি ক্ষুদ্র ইলেকট্রোড মস্তিস্কের গভীরে স্থাপন করা হয়। আর রোগীর বুকে একটি পেসমেকার স্থাপন করা হয়। মস্তিস্কে স্থাপন করা ইলেকট্রোড সংযুক্ত থাকে পেসমেকারের সাথে।
পেসমেকারটির সাহায্যে নির্দিষ্ট মাত্রায় ইলেক্ট্রিক্যাল ইমপাল্স বা বৈদ্যুতিক স্পন্দন মস্তিস্কে পাঠানো হয়, সেটি রোগীর শরীরের কাঁপুনি এবং জড়তা দূর করতে সক্ষম হয়। তবে এই অপরেশন খুব কঠিন এবং ব্যয়বহুল।
চিকিৎসক হুমায়ুন কবির বলেছেন, পারকিনসন্স রোগীর সবার এই অপরেশনের প্রয়োজন হয় না এবং বেশিরভাগ রোগীই ওষুধের মাধ্যমে ভাল থাকে।
“একেবারে শেষ পর্যায়ে গিয়ে বা সিলেকটিভ রোগীর জন্য এই অপারেশন করা যেতে পারে।”
তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশে এই অপারেশন সীমিত পর্যায়ে রয়েছে এবং এপর্যন্ত মাত্র চারজনের এমন অপারেশন করা হয়েছে। তবে এই রোগ প্রতিরোধের কোনও ব্যবস্থা এখনও জানা নেই বলে চিকিৎসকরা বলছেন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা