গর্ভাবস্থায় রোজা

0
366
abm abdullah
Spread the love

রোজা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ সক্ষম স্বাভাবিক জ্ঞান সম্পন্ন সাবালক সব মুসলমান নারী ও পুরুষদের জন্য রমজানে রোজা পালন করা ফরজ। এ মাসে পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছিল। রমজান ছাড়া অন্য কোনো মাসে ফরজ রোজা নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে মুমিনগণ তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হইয়াছে যেরূপ ফরজ করা হইয়াছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, আশা যে তোমরা মুত্তাকি হইবে (সূরা বাকারা: আয়াত ১৮৩)।

আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, তোমাদের যারা এ মাস পাবে, তাকে অবশ্যই এই মাসে রোজা রাখিতে হইবে। যে ব্যক্তি রোগাক্রান্ত অথবা সফরে থাকবে, তবে অন্য সময়ে গণনা রাখিবে (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)

আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য সহজ করতে চান এবং তোমাদের সঙ্গে কঠোরতার ইচ্ছা করেন না, আর যেন তোমরা নির্দিষ্ট সংখ্যা (সমপরিমাণ) পূর্ণ করতে পার এবং তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা কর তোমাদিগকে হেদায়েত করার দরুন। আর যেন তোমরা শোকর করো (সুরা বাকারা: আয়াত ১৮৫)। একদিকে রোজা যেমন ফরজ আবার অন্যদিকে কেউ যদি রোজা পালনে অক্ষম হয় তাদের জন্য ইসলামি শরীয়তে বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, সিয়াম বা রোজা নির্দিষ্ট কয়েকদিন। তবে তোমাদের যারা রোগাক্রান্ত বা সফরে থাকবে, তারা অন্য সময়ে সমপরিমাণ সংখ্যায় পূর্ণ করবে। আর যাদের রোজা পালনের সক্ষমতা নেই, তারা এর পরিবর্তে ফিদিয়া দিবে (সুরা বাকারা: আয়াত ১৮৫)।

রোজা পালনে অক্ষম হলে বা বেশি কষ্ট হলে অথবা জীবনের প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ হলে রোজা ছেড়ে দেওয়া যায়। গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মা যারা তাদের সন্তানদের স্বাস্থ্য নিয়ে শংকিত বা যেখানে শিশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে এমন মায়েদের জন্য রোজা রাখা বাধ্যতামূলক নয় বলে বেশিরভাগ আলেম-ওলামাগণ মত দিয়েছেন। পরে সুবিধামতো সময়ে কাজা আদায় করে নিতে হবে। আর রোজা পালনে অক্ষম ব্যক্তি রোজার পরিবর্তে যে দান করেন তাকে বলা হয় ফিদিয়া।

কখন রোজা রাখবেন গর্ভবতী মা 
শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলে গর্ভবতী মায়ের রোজা রাখতে কোনো নিষেধ নেই। রোজা রাখা নিয়ে গর্ভবতী মায়েরা বেশ চিন্তিত থাকেন। অনেক গর্ভবতী মা রোজা রাখতে চান, আবার অনেকে গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হবে ভেবে রোজা রাখা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে  থাকেন। তবে গর্ভকালীন অবস্থার ওপর ভিত্তি করেই রোজা রাখা নির্ভর করে। প্রথমত দেখতে হবে গর্ভের সময়কাল (যেমন প্রথম তিন মাস, মধ্যবর্তী তিন মাস এবং শেষ তিন মাস), গর্ভবতী কোনো রোগে ভুগছেন কিনা যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানি বা অন্য কোন জটিল রোগ ইত্যাদি। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রোজা রাখার সময়কাল, পারিপার্শ্বিক অবস্থা – শীতকাল বা গরমকাল। শীতকালে রোজা রাখা অনেকটা সহজ আর গরমকালে গর্ভবতী মায়ের পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। এর ফলে শারীরিক দুর্বলতা এবং গর্ভের শিশুর ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। প্রকৃতপক্ষে গর্ভাবস্থায় রোজা রাখা যাবে কি যাবে না তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে মায়ের স্বাস্থ্য এবং গর্ভের সন্তানের অবস্থার উপর। মা ও তার গর্ভের সন্তানের কোনো সমস্যা না হলে, গর্ভবতী নারী সুস্থ ও শক্ত সামর্থ্য হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রোজা রাখা যাবে অনায়াসেই। তবে তার নিজের সুস্থতা, গর্ভের শিশুর নড়াচড়া, ওজন, গতিবিধি  এবং গর্ভের সন্তানের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। একটু সচেতনতা, সুস্থতা আর রুটিন মাফিক জীবনযাত্রা করলে পবিত্র রমজানের রোজা রাখা সহজ হবে।

রোজা রাখার আগে গর্ভবতী মায়ের প্রস্তুতি
রোজা রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একজন গাইনোকোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কোন জটিলতা থাকলে যেমন হাই রিস্ক, ভ্যালুয়েবল প্রেগনেন্সি, অন্য কোনো রোগ আছে কিনা যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তশূন্যতা ইত্যাদি নিরুপণ করে এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে গর্ভধারণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ধরনের যে কোনো জটিলতা থাকলে রোজা না রাখাই শ্রেয়। একজন পুষ্টি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করলে গর্ভবতী মায়ের শরীর সুস্থ ও পুষ্টিমান ভালো থাকবে।

রোজা রাখলে গর্ভবতী মাকে যা করতে হবে 
মনে রাখতে হবে মায়ের গর্ভে অনাগত শিশুর প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি হয়। তাই মায়ের শরীরে সঠিক মাত্রায় নির্দিষ্ট পরিমাণে পুষ্টি, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, পানি ইত্যাদি সরবরাহ জরুরি। এ সময় গর্ভবতী মায়ের শরীরে পুষ্টির অভাব ঘটলে শিশুর পরবর্তী জীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। অবশ্যই পুষ্টিকর খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে। যেমন পরিমিত প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, শাকসবজি এবং ফলমূল ইত্যাদি খেতে হবে। এগুলো শরীরে শক্তি জোগাবে এবং গর্ভস্থ বাচ্চার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গঠনে সহায়ক হবে। ইফতার থেকে সাহরি পর্যন্ত যথেষ্ট পরিমাণে পানি পান করতে হবে। পানির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের পানীয় যেমন ফলমূলের রস লেবুর শরবত পান করা যায়। দৈনিক এক কাপ করে দুধ খেতে পারেন। অবশ্যই সাহরি খেতে হবে, সাহরি না খেয়ে রোজা রাখা উচিত না। এতে শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। ইফতারের সময় ভাজাপোড়া খাবারের চেয়ে অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার খাওয়াই ভালো।
গর্ভাবস্থায় ভারি, গুরুপাক, ভাজাপোড়া, তৈলাক্ত ও বাসি খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। এসময় বেশি বিশ্রাম নিন। দুশ্চিন্তা এড়িয়ে চলুন। বেশি সময় রোদে বা গরমে অবস্থান করা উচিত নয়। রাতে খাবারের পর বিশ্রাম নিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করলে শরীরের জন্য উপকারী। অনেকের গর্ভাবস্থায় কিছু ওষুধ সেবন করতে হয়। তারা দিনের বেলার ওষুধগুলো রাতে খেয়ে নেবেন।

যাদের রোজা রাখা উচিত নয়
গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে বমি বমি ভাব হয়, এমনকি কারও কারও অতিরিক্ত বমি হতে পারে। এছাড়া দুর্বল লাগা, রুচি নষ্ট হওয়া, মাথা ঘোরানো এবং ওজন কমে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। তাই গর্ভকালীন প্রথম তিন মাস রোজা না রাখাই শ্রেয়।

মধ্যবর্তী তিন মাস গর্ভবতী মায়েরা একটু ভালো বোধ করেন, আর এই সময় বাচ্চাটির গঠনও তৈরি হয়ে যায়। যদি অন্য কোনো সমস্যা না থাকে, এ সময় গর্ভবতী মা ইচ্ছা করলে রোজা রাখতে পারেন। একটানা রোজা না রেখে ভেঙে ভেঙে রোজা রাখা যাবে। দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার ফলে যদি গর্ভের সন্তানের নড়াচড়া কমে যায়, তাহলে রোজা না রাখাই উচিত। শেষের তিন মাস গর্ভবতী মাকে সতর্ক হয়ে চলতে হয়। এ সময় বাচ্চা দ্রুত বাড়ে। তাই দুজনের পুষ্টি নিশ্চিত করতে মাকে খাওয়া দাওয়ার বিষয়টিতে জোর দিতে হবে। এ সময়টাতেও রোজা না রাখাই ভালো।

ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণ : যারা হাই রিস্ক প্রেগন্যান্সি বা ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণ করা অবস্থায় রয়েছেন, তাদের একটু বেশি সতর্ক থাকা উচিত। অনেক চিকিৎসার পরও যাদের এ অবস্থা তৈরি হয়েছে, সেসব হাই রিস্ক প্রেগন্যান্সি মায়েদের রোজা না রাখাই ভালো। এমনকি ভ্যালুয়েবল প্রেগনেন্সিতে রোজা না রাখা উচিত।

ডায়াবেটিস : যারা আগে থেকেই ডায়াবেটিস এ ভুগছেন বা যাদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস রয়েছে এবং তা ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, তাদের রোজা না রাখা ভালো।

উচ্চ রক্তচাপ : গর্ভাবস্থায় অনেকের রক্তচাপ বেড়ে যায়। যদি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে জটিলতা দেখা দেয় তবে রোজা না রাখাই শ্রেয়। তবে যারা আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন এবং তা নিয়ন্ত্রণে আছে, তারা রোজা রাখতে পারবে।

কখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত
কোন লক্ষণ থাক বা না থাক, গর্ভাবস্থায় অবশ্যই নিয়মিত ডাক্তারকে দিয়ে চেকআপ করাতে হবে। এছাড়া যদি গর্ভস্থ শিশু নড়াচড়া না করে, তলপেটে ব্যথা বা শারীরিক দুর্বলতা অনুভূত হয়, হাতে পায়ে পানি আসে- তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

রোজা রেখে গর্ভবতী মাকে বিশ্রামে থাকতে হবে। অতিরিক্ত কাজকর্ম বা ভারী কিছু বহন করা যাবে না। সেহেরি, ইফতার ও রাতের খাবারের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। পরিবারের অন্যান্যদের সহযোগিতা ও সহমর্মিতা খুবই জরুরী।

মনে রাখতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় নিজের ও নিজের শিশুর জীবন বিপন্ন করে রোজা রাখা উচিত নয়। আল্লাহতায়ালাও তা চান না। কোরআনেও এ ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।

লেখক :

 অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ

ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে