বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্ট্রাল সেমিনার সাব-কমিটির উদ্যোগে রক্তদূষণ, জীবাণুদুষণ বা রক্তে বিষক্রিয়া সেপসিস নিয়ে রবিবার একটি সেমিনারে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও আশঙ্কাজনক রূপ ধারণ করছে সেপসিস নামক রোগ। যা ব্যাকটেরিয়া (জীবাণু) দ্বারা রক্তের কার্যক্ষমতাকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করে। সেপসিসে আক্রান্ত হলে প্রায় ৫০ শতাংশ রোগীই মৃত্যুবরণ করেন। রোগটির ভয়াবহ আরেকটি দিক হলো এটিকে শনাক্ত করা অনেকটাই কঠিন, যে কারণে এ সেপসিস রোগটি ‘গুপ্ত ঘাতক’ হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে।
সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (একাডেমিক) অধ্যাপক ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন, প্রো-ভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. ছয়েফ উদ্দিন আহমদসহ বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভিন্ন বিভাগের চেয়ারম্যান, বিভিন্ন স্তরের শিক্ষক, কনসালটেন্ট, চিকিৎসক ও রেসিডেন্টরা। সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয় সেন্ট্রাল সাব-কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. বেলায়েত হোসেন সিদ্দিকী। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সহযোগী অধ্যাপক ডা. সম্প্রীতি ইসলাম। সেমিনারে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জেনারেল সার্জারি বিভাগে অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম চৌধুরী, আইসিইউ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সজীব, প্যাথলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাজী ফারহানা খানম।
গবেষণায় দেখা গেছে, সেপসিস আক্রান্ত হয়ে বছরে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছেন। এ সংখ্যা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যার চাইতেও বেশি। সেপসিসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন দরিদ্র এবং মধ্যম আয়ের দেশের মানুষ। শতাংশের হিসেবে যা প্রায় ৮৫ শতাংশ। সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে শিশুরা। পাঁচ বছরের কম বয়সী দশজন শিশুর মধ্যে চারজনের সেপসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, সেপসিসে আক্রান্ত রোগীর ফুসফুস কিডনীসহ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকার্যকর করে দেয়। সেপসিসে মৃত্যুর হার প্রায় ৫০ শতাংশ। এমনকি এ রোগে আক্রান্ত হয়ে যারা আইসিইউতে ভর্তি হয়, সেক্ষেত্রে মৃত্যুর হার আরও বেশি হয়।
তিনি বলেন, সেপসিস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে শিশু ও বয়স্করা অধিক মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকে। তবে সেপসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত ও যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারলে অনেককে বাঁচানো সম্ভব। এক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। আশা করছি, আজকের এ সেমিনার এ রোগে আক্রান্ত রোগীর যথাযথ উন্নত কার্যকরী চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বিরাট অবদান রাখবে, যা সেপসিসে আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যু হার হ্রাসে ভূমিকা রাখবে।
বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে বলা হয়, জীবাণুদূষণ খুবই মারাত্মক অসুস্থতা যার মাধ্যমে জীবাণু রক্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং রক্তের কোষগুলোর কার্যক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে লোপ পায়। এটি দেহের প্রধান অঙ্গসমূহ যেমন-যকৃত, বৃক্ক (কিডনি), হৃদপি-, ফুসফুস, মস্তিষ্ক, অস্ত্র, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থিকে সংক্রমিত করে। বিশেষ করে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা আছে বা মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্রান্স জীবাণুর দ্বারা সংক্রমিত রোগীর দ্রুত অবস্থার অবনতি ঘটে।
চিকিৎসকরা বলেন, মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অতিরিক্ত কাজ করার ফলে এ সেপসিস হতে পারে। এ প্রতিরোধ ক্ষমতা কেবল সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিবর্তে শরীরের অন্যান্য অংশগুলোতেও আক্রমণ শুরু করে। এক পর্যায়ে মানুষের অঙ্গ অকেজো হয়ে যায়। এমনকি বেঁচে থাকা মানুষদেরও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি ও অক্ষমতা নিয়ে চলতে হতে পারে। যেসব ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের কারণে ডায়রিয়া সংক্রমণ বা ফুসফুসের রোগ হয়ে থাকে সেগুলোই সেপসিস হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ। সেপসিসে আক্রান্ত ব্যক্তির হার্ট রেট স্বাভাবিকের চাইতে বেশি হয়।
প্রতিরোধ প্রসঙ্গে বলেন, অনেক দেশের ক্ষেত্রে সেপসিস প্রতিরোধের উপায় হলো সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বিশুদ্ধ পানি এবং সঠিক সময় সঠিক টিকার যোগান। অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে একটি হলো, দেরি হওয়ার আগেই সেপসিস আক্রান্ত রোগীদের ভালোভাবে চিহ্নিত করা এবং দ্রুত তাদের চিকিৎসা শুরু করা। অ্যান্টিবায়োটিক্স বা অ্যান্টি-ভাইরাসের মাধ্যমে প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করলে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। নবজাতকের মধ্যে সেপসিস প্রতিরোধে আমাদের নতুন করে চিন্তা-ভাবনা দরকার এবং এ রোগের এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্দীপক অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল রেজিস্টেন্স মোকাবেলায় প্রয়োজন আরও বেশি সজাগ হওয়া।