অ্যাজমার কারন ও চিকিৎসা

0
907
Spread the love

দিন দিন বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা, করোনার অন্যতম উপসর্গ শ্বাসকষ্ট, যারা আগে থেকেই অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন তাদের বেশী সতর্ক থাকতে হবে। শিশুসহ যেকোনো বয়সী নারী-পুরুষ অ্যাজমায় আক্রান্ত হতে পারে। এটা সারা জীবনের রোগ হলেও সঠিক চিকিৎসা নিলে ভালো থাকা যায়। অ্যাজমায় মানুষ মারা যায় না বললেই চলে। কিন্তু সুচিকিৎসার অভাবে তারা বেশ কষ্ট পায়। আসুন আমরা জেনে নিই অ্যাজমা কি ও তার চিকিৎসা সম্পর্কে –

অ্যাজমাঃ

শ্বাসনালির ক্রনিক প্রদাহজনিত দীর্ঘস্থায়ী রোগ অ্যাজমা, যা হাঁপানি নামে পরিচিত। এর ফলে শ্বাসনালিতে বিভিন্ন কোষ, বিশেষত ইয়োসিনোফিল ও অন্যান্য কোষীয় উপাদান জমা হয়ে শ্বাসনালি অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। অ্যাজমার কারণে শ্বাসনালির ছিদ্রপথ সরু হয়ে যায়। ধুলাবালি, ধোঁয়া ইত্যাদির প্রতি অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীল হয়। রোগী শ্বাসকষ্টসহ শুকনো কাশি, বুক জ্যাম হওয়া, শ্বাস নেওয়া ও ছাড়ার সময় বুকে শাঁ শাঁ শব্দ হওয়া ইত্যাদি সমস্যায় ভুগতে থাকে। অ্যাজমায় মানুষ মারা যায় না বললেই চলে। কিন্তু সুচিকিৎসার অভাবে তারা বেশ কষ্ট পায়। শীতকালের শুষ্ক ঠা-া আবহাওয়া, বাতাসে উড়ে বেড়ানো ধূলিকণার আধিক্যে অ্যাজমার প্রকোপ বাড়ে। যাদের আগে থেকে অ্যাজমা ছিল না, তাদেরও শীতকালে অ্যাজমায় আক্রান্ত হতে দেখা যায়।

কারণঃ

অ্যাজমার কারণ আজ পর্যন্ত অজানা। আবার ঠিক কী কারণে কিছু মানুষের শ্বাসনালি সাধারণ ধুলিবালির সংস্পর্শে সরু হয়ে শ্বাসকষ্টের উদ্রেক করে; তা এখনো মানুষের নাগালের বাইরে। তবে বংশগত বা জেনেটিক ও পরিবেশগত উপাদানের পারস্পরিক ক্রিয়ার মাধ্যমে এ রোগের উদ্ভব ঘটে বেশি। কিছু উপাদান অ্যাজমা রোগের উৎপত্তি, আক্রমণ ও স্থায়িত্বকে বেশ প্রভাবিত করে থাকে, যাকে ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান বলে। এই ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান রোগীসংশ্লিষ্ট ও পরিবেশগত এই দুই ধরনের।

রোগীসংশ্লিষ্ট কারণঃ

বংশগত বা জেনেটিক : যদি মা-বাবার অ্যাজমা থাকে, তবে সন্তানের অ্যাজমা হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
এটপি : এটপি মানে এ ধরনের রোগীদের রক্তে ইমুন্যুগ্লুুুবিউলিন-ই (ওমঊ) নামক অ্যান্টিবডির আধিক্য থাকে। এই রোগীদের অ্যাজমা ও অন্যান্য অ্যালার্জিজনিত রোগ যেমন-একজিমা, রাইনাইটিস বেশি হয়। তবে অ্যাজমা আক্রান্ত মা যদি শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান, তাহলে এ রোগগুলোর আশঙ্কা কমে।

অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীল শ্বাসনালি : এ ধরনের শ্বাসনালি খুব সহজেই সংকুচিত হয়ে যায়।

লিঙ্গ: সাধারণত শিশু বয়সে ছেলেদের ও প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বেশি অ্যাজমা দেখা যায়।

পরিবেশগত কারণঃ

অ্যালার্জেন: সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অ্যাজমার ঝুঁকি, যেমন পশুর লোম, আরশোলা, রেণু, ছত্রাক ইত্যাদি।

উত্তেজক: সিগারেটের ধোঁয়া, কারখানার উত্তেজক পদার্থ, ঠা-া বাতাস, রঙের ঝাঁজালো গন্ধ, মসলা, সুগন্ধি প্রভৃতি।

ওষুধ: অ্যাসপিরিন, ব্যথানাশক, বিটা ব্লকারস, হিরোইন প্রভৃতি।

এ ছাড়া টিনজাত ফলের, ভাইরাসজনিত শ্বাসনালিতে সংক্রমণ, দৈহিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম অ্যাজমা ট্রিগার করে থাকে, অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতা : যেমন অট্টহাসি, কান্না ছাড়াও অ্যাজমার অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান রয়েছে।

লক্ষণঃ

– শ্বাসনালি সংকুচিত হওয়ার ফলে রোগীর শ্বাসকষ্ট হয়।

– বুকে চাপ বা জ্যাম লাগা অনুভূত হয়।

– কাশি বা শুকনো কাশি হয়।

– শ্বাস নেওয়া ও ছাড়ার সময় বুকে বাঁশির মতো শাঁ শাঁ শব্দ হয়।

প্রকারভেদঃ

এটপিক অ্যাজমা: যেসব অ্যাজমা রোগীর এটপি থাকে তাদের এটপিক অ্যাজমা বলে। এ রকম রোগীদের অ্যাজমার কারণ অ্যালার্জিজনিত—অন্যগুলো নন-এটপিক অ্যাজমা।

ব্যায়াম প্রভাবিত: ব্যায়ামের সময় যে অ্যাজমার প্রকোপ হয়, তাকে ব্যায়াম প্রভাবিত অ্যাজমা বলে।

অকুপেশনাল অ্যাজমা: পেশাগত পরিবেশে রোগীরা যেমন—গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি, বার্বুচি, জুট মিল শ্রমিক ইত্যাদি অকুপেশনাল অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়।

এ ছাড়া আছে সিজনাল অ্যাজমা, যা ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে বাড়ে বা কমে।

অ্যাজমা রোগের তীব্রতার ওপর ভিত্তি করে সবিরাম, মৃদু স্থায়ী, মাঝারি স্থায়ী ও তীব্র স্থায়ী এই চার ভাগে ভাগ করা হয়। এটা অ্যাজমা চিকিৎসার প্রধান নির্দেশক।

পরীক্ষা-নিরীক্ষাঃ

বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে অ্যাজমা রোগ নির্ণয়ে কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। তবে অ্যাজমার মতো অন্য রোগ যেমন সিওপিডি, হার্ট ফেইলিওর, শিশুদের ক্ষেত্রে ব্রংকিউলাইটিস ইত্যাদি অ্যাজমার মতো লক্ষণ নিয়ে আসে। সে ক্ষেত্রে পরীক্ষার সঙ্গে রোগের লক্ষণ মিলিয়ে অ্যাজমা রোগ নির্ণয় করা হয়। অ্যাজমার প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগুলো হলো –

– রোগীর শ্বাসনালিতে শ্বাস গ্রহণে বাধা আছে কি না তা স্পাইরোমেট্রি বা পিক ফ্লো মেট্রি পরীক্ষায় নির্ণয় করা হয়। স্পাইরোমেট্রি দিয়ে অ্যাজমা ও সিওপিডি এই দুটি রোগ পার্থক্য করা যায়।
– কাশিপ্রধান অ্যাজমার ক্ষেত্রে মেথাকলিন চ্যালেঞ্জ পরীক্ষা করে শ্বাসনালির অতি প্রতিক্রিয়াশীলতা দেখা যায়।
– রক্তে ও কফে ইয়োসিনোফিল বেড়ে যায়।
– রক্তে সিরাম ইমুন্যুগ্লুবিউলিন-ই (ওমঊ) অ্যালার্জিজনিত অ্যাজমা বেড়ে যায়। তবে অ্যাজমা চিকিৎসায় এর তেমন ভূমিকা নেই।

– অ্যালার্জেন বা ট্রিগার পরীক্ষার জন্য স্কিন প্রিক টেস্ট করা হয়। তবে এ টেস্ট সব রোগীর ক্ষেত্রে প্রয়োজন পড়ে না।

কিভাবে বুঝবেন?

রোগী নিজেকে নিচের প্রশ্নগুলো করতে পারেন, যদি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়, তবে ধরে নিতে হবে তিনি অ্যাজমা রোগী। তখন কালক্ষেপণ না করে ডাক্তার দেখানো উচিত।

– শ্বাসের সময় বুকে বাঁশির মতো শাঁ শাঁ শব্দ হয় কি?

– রাতে কি তীব্র কাশি হয়?

– ব্যায়ামের পর কাশি বা শ্বাসকষ্ট হয় কি?

– বায়ুবাহিত অ্যালার্জেন বা উত্তেজকের সংস্পর্শে কাশি বা শ্বাসকষ্ট অনুভব হয় কি?

– রোগীর কখনো ঠা-া লাগলে কি ১০ দিনের বেশি থাকে?

– রোগীর লক্ষণ কি অ্যাজমার ওষুধে ভালো হয়ে যায়?

ঝুঁকি বোঝার উপায়ঃ

সাধারণত অ্যাজমায় মৃত্যুহার শতকরা ১ ভাগের নিচে। তবে অ্যাজমায় জীবন ঝুঁকিপূর্ণ আক্রমণ নিম্নরূপ লক্ষণ থেকে বোঝা যায়।

– যদি রোগী শ্বাসকষ্টের জন্য এক নিঃশ্বাসে একটি পূর্ণ বাক্য বলতে না পারে।

– যদি রোগীর জ্ঞান স্বাভাবিক না থাকে বা অজ্ঞান হয়ে যায়।

– সোজা হয়ে বসে থাকার প্রবণতা থাকে।

– নাকের অগ্রভাগ নীল হয়ে গেলে।

– শ্বাস-প্রশ্বাস মিনিটে ৩৫-এর বেশি হলে।

– নাড়ি মিনিটে ১২০-এর বেশি হলে।

এসব লক্ষণ দেখা মাত্রই হাসপাতালে নেওয়া দরকার।

ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান থেকে বাঁচতে করণীয়ঃ

অ্যাজমা চিকিৎসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে—ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান থেকে নিজেকে দূরে রাখা। এ জন্য নিম্নরূপ ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে :

– ব্যবহূত বালিশ, তোশক ও মেট্রেসে অচ্ছেদ্য কাভার দিলে ভালো হয়।

– বিছানার সব কিছু অন্তত সপ্তাহে একবার অধিক তাপে বিশুদ্ধ করা।

– কার্পেট না রাখলে ভালো। রাখলেও নিয়মিত ট্যানিক এসিডে পরিষ্কার করা।

– শিশুদের খেলনা নিয়মিত ধুয়ে রাখা।

– ঘরে কোনো পোষা প্রাণী না রাখা ভালো। রাখলেও নিয়মিত সপ্তাহে অন্তত দুদিন গোসল করানো।

– বাসায় ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করা ভালো।

চিকিৎসাঃ

উপশমকারী ওষুধ: যেমন সালবিউটামল। এ ওষুধ তাত্ক্ষণিতকভাবে শ্বাসনালির ছিদ্রপথ প্রসারিত করে শ্বাস-প্রশ্বাসের বাধা কমিয়ে দেয়। যদিও এর কার্যকাল খুবই কম।

প্রতিরোধক ওষুধ: যেমন স্টেরয়েড, অ্যামাইনোফাইলিন, ক্রোমগ্লাইকেট ইত্যাদি।

ইনহেলার পদ্ধতি: এটি সবচেয়ে উপকারী এবং আধুনিক পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে ওষুধ শ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে প্রবেশ করে শ্বাসনালিতে কাজ করে। ফলে খুবই অল্প মাত্রার ওষুধ প্রয়োগে অধিক সুবিধা হয়। পাশাপাশি যেহেতু ওষুধ রক্তে খুব একটা যায় না, ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না বললেই চলে। তবে রোগীকে এর ব্যবহার শেখানোটা একটু কঠিন।

খাবার বড়ি/ক্যাপসুল/সিরাপ: এ পদ্ধতি শিশু বা অক্ষম ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। এতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি। কারণ অধিক মাত্রার ওষুধ রোগীর রক্তে প্রবেশ করে।

নেবুলাইজার: তীব্র অ্যাজমার আক্রমণে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়। তবে মনে রাখতে হবে, নেবুলাইজার যথাযথভাবে জীবাণুমুক্ত না রাখলে এর মাধ্যমে জীবাণু সংক্রমণ হয়।

ইনজেকশন: অ্যাজমার মারাত্মক আক্রমণে শিরায় স্টেরয়েডের ইনজেকশন দেওয়া হয়। তবে আমাদের দেশে অযৌক্তিকভাবে অতিরিক্ত হারে অ্যামাইনোফাইলিন ব্যবহূত হয়, যা কখনো কখনো হৃদযন্ত্রের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া করে।

লেখকঃ
অধ্যাপক এ কে এম মোশাররফ হোসেন
বক্ষব্যাধি বিশেষঙ্গ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে