করোনাভাইরাস সারা দেশের গ্রামগঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, সেভাবে বাড়েনি করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা। সংক্রমণ থেকে বাদ পড়েনি দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরীক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়নি। এমনকি উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে গিয়ে পরীক্ষা করাতে প্রয়োজনীয় জনসচেতনতা সৃষ্টিতে রয়েছে দুর্বলতা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশ নেপাল, ভুটান বা শ্রীলংকায় দৈনিক পরীক্ষার হার আমাদের তুলনায় দ্বিগুণ। এই মুহূর্তে যদি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরীক্ষার হার বাড়ানো হয় তবে সংক্রমণের হার নিশ্চিত হবে। সে অনুযায়ী প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে। অন্যথায় ঝুঁকি বাড়বে, কঠিন হবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোয় সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৩২টি আরটি পিসিআর মেশিনে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হয়। একইভাবে ৪৪টি জিনএক্সপার্ট মেশিনে কোভিড-১৯ পরীক্ষা চলছে। পাশাপাশি ৩৩৪টি স্থানে র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। শনিবার দেশের ৩২টি জেলায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা শূন্য থেকে ১০ জনের মধ্যে এবং ২৯টি জেলায় নমুনা সংগ্রহ হয়েছে শূন্য থেকে ৫০-এর নিচে। অথচ প্রতিটি উপজেলা থেকে ৫০টি নমুনা সংগ্রহ করা হলেও এই সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
অধিদপ্তর আরও জানায়, চলতি বছরে সংক্রমণের ২৩তম সপ্তাহ শেষ হলো। যেখানে ২২তম সপ্তাহে সারা দেশে ১,১৯,২০২টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়, যেখানে ২৩তম সপ্তাহে পরীক্ষা হয়েছে ১,২২,১০৩টি। অর্থাৎ নমুনা পরীক্ষার হার বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ২২তম সপ্তাহে শনাক্ত হন ১১,৯২৮ জন রোগী এবং ২৩তম সপ্তাহে শনাক্ত হন ১৪,৫৯৯ জন। অর্থাৎ এক সপ্তাহের তুলনায় শনাক্ত বেড়েছে ২৭ দশমিক ২০ শতাংশ। এই সময়ে মৃত্যু বড়েছে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সীমান্ত ও আশপাশের এলাকার সব মানুষ বিশেষ করে যাদের লক্ষণ রয়েছে তাদের সবাইকে পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। যদিও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী করোনা পরীক্ষায় তেমন আগ্রহী নন। এক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক নেতাদের এগিয়ে আসতে হবে। মসজিদের ইমাম, স্কুলশিক্ষক, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা এবং সিভিল সার্জনদের নমুনা সংগ্রহে ও পরীক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের ৬৪ জেলা, ৪৯৩টি উপজেলা এবং অধিক জনসমাগম স্থানে পরীক্ষার ব্যবস্থা করাতে হবে।
এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপ মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ বলেন, দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় সংক্রমণ ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে যারা অবৈধ পথে আসছে, তাদের মাধ্যমে অধিক সংক্রমণশীল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ছে। এক্ষেত্রে সীমান্তে নজরদারি কঠোর করতে হবে। পাশাপাশি দেশের সব উপজেলা পর্যায়ে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখান থেকে জেলা বা উপজেলায় যাতায়াত দুরূহ, সেখানে র্যাপিড অ্যান্টিজেন এবং জিনএক্সপার্টের পরীক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি এটি যেন দেশের সব অঞ্চলে ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য এসব এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্প্রতি ঈদুলফিতরকে কেন্দ্র করে মানুষ কয়েক দফায় ঢাকা থেকে গ্রামে গিয়েছে। সেখানে গিয়ে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে অবাধ চলাফেরা করে ভাইরাসটির বিস্তার ঘটিয়েছে। তা থেকেই অসচেতন গ্রামবাসীর মধ্যে করোনা নীরবে সংক্রমণ ঘটিয়ে চলেছে। এছাড়া ভারতে মারাত্মক সংক্রমণশীল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার ঘটেছে। এই সময়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রতিদিন ভারত থেকে বৈধ-অবৈধ পথে দেশে ফিরেছে। যাদের বেশির ভাগই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে এসেছেন। মহামারির মধ্যে ঈদকে কেন্দ্র করে মানুষের বাড়ি যাওয়া এবং ভারত ফেরতদের অনেকেই সুপ্ত অবস্থায় করোনাভাইরাস শরীরে বহন করে প্রত্যান্ত অঞ্চলে হাটবাজার, আত্মীয়ের বাড়িতে ঘুরে এটি ছড়িয়েছেন। এসব স্থানে হাঁচি-কাশি, কথা বলার মাধ্যমে সুপ্ত ভাইরাসটি রেখে এসেছেন। ফলে এসব এলাকায় ধীরে ধীরে ভাইরাসটির প্রসার ঘটতে শুরু করেছে। বিভিন্ন গ্রামে প্রায় প্রতিদিনই করোনার উপসর্গ নিয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। কিন্তু ওই পরিবারের অন্য কারও নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে না বা তাদের আইসোলেশনেও রাখা হচ্ছে না। পরীক্ষার আওতায় না আসায় এরা থেকে যাচ্ছেন শনাক্তের বাইরে। এদের পরীক্ষার আওতায় আনতে না পারলে দেশের করোনা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটনো দুরূহ বলে মনে করছেন তারা।
শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো বড় শহরের তুলনায় এখন দেশের গ্রামাঞ্চলে সংক্রমণের হার বেশি। গ্রামের মানুষ এখনো করোনার অস্তিত্ব শিকার করেন না। জ্বর, সর্দি, কাশিতে ভুগলেও হাসপাতালে বা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন না। এমনকি করোনার সব লক্ষণ প্রকাশ পেলেও তারা পরীক্ষা করাতে যান না। অনেকে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন; কিন্তু সেগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবে দৃশ্যমান যে সংক্রমণের হার দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত হার তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এক্ষেত্রে করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গ্রামপর্যায়ে লকডাউন কার্যকর করতে হবে। স্থানীয়ভাবে সন্দেহজনক সবাইকে পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। আক্রান্তদের প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। অধিক সংক্রমণশীল এলাকার সঙ্গে শহরের যোগাযোগ বন্ধ রাখতে হবে। অন্যথায় শহরেও দ্রুত এর প্রভাব পড়বে। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।