করোনার সঙ্গে স্নায়ু রোগের সম্পর্ক!

0
718
Spread the love

করোনা ভাইরাস প্রতিনিয়ত তার রূপ পরিবর্তন করছে। এই ভাইরাসের উপসর্গও পরিবর্তিত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, স্নায়বিক রোগসমূহও করোনার অন্যতম উপসর্গ। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের নানা ধরনের স্নায়বিক রোগে ভুগতে দেখেছেন চিকিৎসকরা।

এ ধরনের স্নায়বিক রোগীরা প্রচলিত চিকিত্সায় সেরে উঠছেন না। এ প্রেক্ষিতে তাদের পরীক্ষা করে দেখা গেছে, অধিকাংশ রোগীই করোনায় আক্রান্ত। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতালে আসা স্নায়বিক রোগীদের বেশির ভাগই চিকিত্সায় সুস্থ হচ্ছেন না। যদিও তাদের মধ্যে করোনার কোনো উপসর্গ নেই। পরে চিকিত্সকরা পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখেন যে, তারা করোনায় আক্রান্ত।

সম্প্রতি এক পরিসংখ্যানে এমনটা দেখা গেছে। যা চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা গবেষণা শুরু করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিউরো ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যোগাযোগও করা হচ্ছে।

কখনো উপসর্গ ছাড়াই করোনা ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে মানুষের শরীরে। কখনো ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন শেষ হওয়ার পরও শরীরে করোনার সন্ধান মিলছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তীব্র জ্বর, সর্দি-কাশি, শুকনো কাশি ও শ্বাসকষ্টকে শুরুতে কোভিড-১৯-এর লক্ষণ বা উপসর্গ বলে ধরে নেওয়া হলেও যতই দিন যাচ্ছে করোনার নতুন নতুন উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। কাঁপুনি, পেশিতে যন্ত্রণা, মাথাব্যথা, কিছুতে স্বাদ না পাওয়া এবং কোনো কিছুতে গন্ধ না পাওয়ার মতো লক্ষণ যোগ হচ্ছে করোনা ভাইরাসের উপসর্গের তালিকাতে।

করোনায় সর্বশেষ যোগ হওয়া স্নায়বিক রোগসমূহ

স্ট্রোক: মস্তিষ্কের কোনো অংশে রক্ত সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি হলে ঐ অংশের কোষগুলো নষ্ট হওয়াকে স্ট্রোক বলা হয়। আগে স্ট্রোকের রোগীদের চিকিত্সা দিলে ভালো হয়ে যেতেন। কিন্তু বর্তমানে অনেক স্ট্রোকের রোগী চিকিত্সায় ভালো হচ্ছেন না। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে চিকিত্সকরা দেখতে পান যে, করোনার উপসর্গ হিসেবে তার স্ট্রোক হয়েছে। এ কারণে আগের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি স্ট্রোকের রোগী মারা যাচ্ছেন।

জিবিএস: এটি একটি ভয়ানক রোগ। অনেক সময় কোনো লক্ষণই নেই, হঠাৎ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখা যায়, হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে দুই পা নাড়াতে পারছেন না। আস্তে আস্তে হাতও নাড়াতে পারছেন না। ক্রমান্বয়ে হাত ও পায়ের শক্তি কমে যায়। চিকিত্সায় এই রোগ ভালো হয়ে যায়। তবে বর্তমানে জিবিএস রোগে আক্রান্তদের চিকিত্সা দিয়েও ভালো করা যাচ্ছে না। রোগীর নাকে ও জিহ্বায় স্বাদ থাকছে না। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ঐ রোগী করোনায় আক্রান্ত। অর্থাৎ করোনার কারণে জিবিএস রোগে আক্রান্ত হচ্ছে লোকজন।

মুখ বাঁকা: সকালে ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ লক্ষ করলেন, মুখের এক পাশ বাঁকা হয়ে গেছে। খেতে গেলে মুখের এক পাশ দিয়ে পানি পড়ে যায়, এক পাশের চোখ বন্ধ হয় না। এ রকম পরিস্থিতিতে সবাই ধারণা করেন, রোগীর নিশ্চয়ই ‘স্ট্রোক’ হয়েছে। এটি স্নায়ুগত সমস্যা ঠিকই, তবে তা স্ট্রোক নয়। এই রোগের নাম ‘বেলস পালসি’। এটি মুখ বাঁকা রোগ নামেও পরিচিত। এই রোগ হলে আগে যে চিকিত্সা দেওয়া হতো, এখন সেই চিকিত্সায় কাজ হচ্ছে না। অর্থাৎ রোগী করোনায় আক্রান্ত, যার করোনার কারণে এই মুখ বাঁকা রোগ হয়েছে। এ ধরনের রোগী এখন প্রচুর পাওয়া যাচ্ছে।

এনকেফেলাইটিস:এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ যার সংক্রমণ মানুষ ও অন্যান্য পশুর মধ্যে ঘটে থাকে। খিঁচুনি, জ্বর ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এই রোগের লক্ষণ। ভাইরাসসহ বিভিন্ন কারণে এই রোগ হয়। এতে মৃত্যুর হার বেশি। বর্তমানে এনকেফেলাইটিস অনেক রোগী আসছে, যাদের চিকিত্সায় কোনো কাজ হচ্ছে না। এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের পরীক্ষা করে দেখা গেছে, অধিকাংশই করোনায় আক্রান্ত। অর্থাৎ করোনার কারণে তার এ রোগ হয়েছে।

নিউরোপ্যাথি: এই রোগে আক্রান্ত রোগীর নার্ভ কাজ করে না। নার্ভ দুর্বল হয়ে যায়। শক্তি পায় না। ডায়াবেটিস কিংবা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে এই রোগ হতে পারে। আগে চিকিত্সা ও প্রয়োজনীয় ওষুধে এ রোগ ভালো হয়ে যেত। কিন্তু বর্তমানে নিউরোপ্যাথি আক্রান্ত অধিকাংশ রোগী চিকিত্সায় ভালো হচ্ছেন না। এছাড়া করোনায় আক্রান্ত অনেক রোগী স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলছেন। যদিও তাদের শরীরে করোনার কোনো উপসর্গ নেই। অবশ্য সিটি স্ক্যান ও এমআরআই করার পর দেখা যাচ্ছে, তারা করোনায় আক্রান্ত। দুই পা অবশ হয়ে যাওয়া, প্রশ্রাব-পায়খানা বন্ধ হয়ে যাওয়া। অর্থাত্ প্যারালাইসিস। তাদের শরীরে করোনার লক্ষণও ছিল না। এ জাতীয় রোগীর সুস্থতার হার খুবই কম। যেসব কারণে এ রোগ হয়, বর্তমানে সেসব কারণও পরীক্ষায় পাওয়া যায়নি। এ কারণে ওষুধেও কাজ হচ্ছে না। এন্ট্রি ভাইরাল ওষুধ দিয়েও কাজ হচ্ছে না।

ব্রেনে রক্ত জমাট বাঁধা: স্ট্রোকের কারণে আগে এমনটা হতো। এখন কোভিডের কারণে ব্রেনে রক্ত জমাট বাঁধে। অর্থাৎ করোনা ভাইরাসের উপসর্গগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ব্রেনে রক্ত জমাট বাঁধা।

ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স: শরীরে সোডিয়াম ও পটাশিয়াম কমে যাওয়াকে বলা হয় ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স। ইদানীং দেখা যায় মাথাব্যথা, মাথা ঘুরানো ও খিঁচুনির মতো উপসর্গ নিয়ে অনেক রোগী হাসপাতালে আসেন। তাদের শরীরে করোনার লক্ষণ নেই। পরীক্ষায় দেখা যায়, এসব সিংহভাগই করোনায় আক্রান্ত। চিকিত্সকদের মতে, করোনার কারণে তাদের এ সমস্যা।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতালের পরিচালক প্রখ্যাত নিউরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ ও যুগ্মপরিচালক অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম বলেন, স্নায়বিক রোগসমূহ করোনার অন্যতম উপসর্গ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বর্তমানে নিউরোলজিক্যাল যেসব রোগে আক্রান্ত হয়ে রোগীরা আসছেন তাদের বেশির ভাগই করোনায় আক্রান্ত। এটি আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। ওষুধেও কাজ হচ্ছে না। এ ব্যাপারে গবেষণা চলছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রখ্যাত নিউরোলজিস্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে