কাঁচা দুধ পানে হতে পারে ব্রুসোলেসিস রোগ, জেনে নিন কারা বেশি ঝুঁকিতে?

0
228
Spread the love

সম্প্রতি দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় আট জনের মধ্যে ব্রুসেলোসিস রোগ শনাক্ত হয়েছে। গবাদি পশু থেকে ছড়ায় সংক্রামক এই রোগটি।

উপজেলার রেসপিরেটরি ডিজিজ হাসপাতালে গত বছর বেশ কয়েকজন রোগী করোনার উপসর্গ নিয়ে আসেন। তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় করোনা নেগেটিভ এলেও ওই রোগীরা বার বার জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছিলেন।
এ অবস্থায় তাদের রোগের কারণ নির্ণয়ে ট্রিপল অ্যান্টিজেন টেস্ট করানো হয়। এই টেস্টের মাধ্যমে ব্রুসেলা, সালমোনেলা, রিকেটশিয়া এই তিন ধরণের ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর’বি) গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে অগাস্ট পর্যন্ত এরকম ১৫৩ জনের ট্রিপল অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করে শিশুসহ ৮ জনের শরীরে ব্রুসেলোসিস রোগ শনাক্ত করে। এই রোগীদের গবাদি পশুর কাঁচা দুধ পানের ইতিহাস ছিল বলে জানিয়েছেন আইসিডিডিআরবি’র বিজ্ঞানীরা।

ব্রুসেলোসিস কী এবং কেন হয়

ব্রুসেলোসিস হল, “ব্রুসেলা” ব্যাকটেরিয়াজনিত এক ধরনের জুনোটিক রোগ, অর্থাৎ এটি পশু থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায়। সাধারণত গৃহপালিত গবাদি পশু যেমন: গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, শূকর থেকে এই রোগ ছড়াতে পারে। এটি ‘ভূমধ্যসাগরীয় জ্বর’ বা ‘মল্টা জ্বর’ নামেও পরিচিত।

ব্রুসেলোসিস বেশ সংক্রামক হওয়ায় কেউ আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে এলে কিংবা আক্রান্ত পশুর কাঁচা দুধ বা কাঁচা দুধ থেকে তৈরি খাবার খেলে এই রোগ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। কারণ কাঁচা দুধে ব্রুসেলা নামক ব্যাকটেরিয়া পরজীবী হিসেবে থাকে যা খেলে সেই জীবাণু মানুষের দেহে প্রবেশ করে।

তবে সব প্রাণীর দুধেই যে ব্রুসেলা থাকে, তা নয়। শুধুমাত্র অসুস্থ পশুর কাঁচা দুধেই এই ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত হয়েছে। ঐ দুধ দিয়ে যদি দই, পনির, ঘোল, মাঠা, আইসক্রিম বা অন্য কিছু তৈরি করা হয় তাহলেও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

আবার গবাদি পশুর কাঁচা বা আধাসেদ্ধ মাংস খেলে, শরীরে কাটছেড়া থাকা অবস্থায় অসুস্থ প্রাণীর রক্ত, মাংস, মল-মূত্রের সংস্পর্শে এলেও মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। গবাদি পশু এই রোগে আক্রান্ত অবস্থায় সন্তান ধারণ করলে গর্ভপাত হতে পারে। যদি সেই গর্ভপাতের রক্ত কোন মানুষের শরীরের কাটা অংশের সংস্পর্শে আসে তাহলে এতে তিনি আক্রান্ত হতে পারেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের তথ্য মতে, ব্রুসেলোসিস মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়া অত্যন্ত বিরল। সংক্রামিত মায়েরা যারা বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন তারা তাদের শিশুদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতে পারেন কিংবা যৌন সম্পর্ক থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর ঘটনা ঘটলেও খুব কম রিপোর্ট করা হয়েছে। টিস্যু প্রতিস্থাপন বা রক্তের সংক্রমণের মাধ্যমেও সংক্রমণ ঘটতে পারে।

প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ

বিশেষজ্ঞরা কাঁচা দুধ, বা কাঁচা দুগ্ধজাত খাবার এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আইসিডিডিআরবি’র সহকারী বিজ্ঞানী ও জুনোটিক রোগ বিশেষজ্ঞ আইরিন সুলতানা শান্তা জানান, “সরাসরি কাঁচা দুধ পান না করে বা কাঁচা দুধে বানানো খাবার না খেয়ে সেই দুধ যদি অন্তত ১৫ মিনিট ফোটানো হয় তাহলে এই ব্যাকটেরিয়া মরে যায়। কাঁচা দুধ একবার ফুটিয়ে পরে ঠাণ্ডা অবস্থায় খেলেও কোনও ঝুঁকি নেই।”

আবার কারখানায় পাস্তুরিত দুধে এই ব্যাকটেরিয়া থাকে না। তবে অনেক প্যাকেটজাত দুধে পাস্তুরিত শব্দটি লেখা থাকলেও এটি নিরাপদ নাও হতে পারে। তাই যে দুধই হোক সেটি ফুটিয়ে খাওয়াই নিরাপদ বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

টেকনাফের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে তারা জানতে পারেন ওই এলাকার মানুষের মধ্যে গবাদি পশুর কাঁচা দুধ পানের প্রবণতা রয়েছে। কারণ তারা মনে করে কাঁচা দুধ খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য বেশি উপকারী। আবার দুধ ফোটালে সেটির পরিমাণ কমে যায় বলে অনেক দরিদ্র পরিবার ফুটিয়ে খেতে আগ্রহী হয় না।

এদিকে কাঁচা বা আধা সিদ্ধ মাংস খেলেও ব্রুসেলোসিস হতে পারে। তবে বাংলাদেশে যেভাবে মাংস দীর্ঘ সময় রান্না করে খাওয়া হয় তাতে ঝুঁকি কেটে যায়। ব্রুসেলোসিস প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর কৌশল হল পশুদের মধ্যে সংক্রমণ নির্মূল করা। গবাদি পশুকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া এবং সম্ভব হলে টিকার ব্যবস্থা করা।

আর পশু থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ প্রতিরোধে স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, পেশাগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। একই সাথে কৃষি কাজ, গরুর খামার দেখভাল এবং মাংস প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা।

লক্ষণ ও চিকিৎসা

ব্রুসেলোসিসের লক্ষণগুলো ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের দুই দিনের মাথায় কিংবা কয়েক সপ্তাহ পরে দেখা দিতে পারে। এই লক্ষণগুলো অনেকটা ফ্লুর মতো-

# তীব্র জ্বর এবং জ্বর ওঠানামা করবে
# পিঠ এবং জয়েন্টে ব্যথা
# মাথাব্যথা
# চরম ক্লান্তি ও দুর্বলতা
# ক্ষুধামন্দা ও ওজন হ্রাস
# অস্থিরতা ও ঘাম হওয়া
# ব্রুসেলোসিসের লক্ষণগুলো কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে আবারও ফিরে আসতে পারে।

তবে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষণ এবং উপসর্গ বেশ জটিল হতে পারে বলে জানিয়েছেন আইসিডিডিআরবি’র টেকনাফে অবস্থিত রেসপিরেটরি ডিজিজেস হাসপাতালের সিনিয়র প্রোগ্রাম কোঅরডিনেটর ডা. জিয়াউল ইসলাম।

তিনি জানান, এই ব্যাকটেরিয়া কারো শরীরে একবার প্রবেশ করলে সেটি সুপ্ত অবস্থায় কয়েক মাস পর্যন্ত থাকতে পারে। পরে উপযোগী পরিবেশ পেলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গকে সংক্রমিত করতে থাকে।

আর্থ্রাইটিস হল দীর্ঘমেয়াদি ব্রুসেলার একটি উপসর্গ। সেই সাথে এটি স্নায়ুতন্ত্র, যকৃৎ ও প্লিহা এমনকি হৃদযন্ত্রে প্রদাহ তৈরি করতে পারে।

তীব্র সংক্রমণে রোগীর বার বার জ্বর ওঠানামা করে, ভীষণ দুর্বলতা, মাথা ও শরীরে ব্যথা, পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, বমি বমি ভাব এমনকি বিষণ্ণতাও হতে পারে।

চিকিৎসা

কেউ এই রোগে একবার আক্রান্ত হওয়ার পর যদি সময়মত চিকিৎসা না করান তাহলে তীব্র সংক্রমণে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে বলে বলছেন বিজ্ঞানীরা। তবে আক্রান্ত ব্যক্তি ধৈর্য ধরে টানা দেড় মাস অ্যান্টিবায়োটিক খেলে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। কয়েকদিন ওষুধ খাওয়ার পর রোগী ভাল বোধ করলেও কোর্স অবশ্যই শেষ করা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

এ নিয়ে ডা. জিয়াউল ইসলাম জানান “এই রোগ নিয়ে প্যানিক হওয়ার কিছু নাই। প্রথম কথা হল সাবধান থাকা। এরপরেও যদি কেউ আক্রান্ত হন তাহলে ডাক্তারের পরামর্শে দিনে দুইবেলা অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হবে। ওষুধের খরচও খুব একটা বেশি না। কিন্তু ওষুধ নিয়ম মতো ফুল কোর্স খেলে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন।”

তবে কেউ যদি ওষুধ ঠিক মতো না খান এবং আক্রান্ত হওয়ার পরও জীবনযাপনে অসতর্ক থাকলে সংক্রমণের পুনরাবৃত্তি হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।

ব্রুসেলোসিসের বিরুদ্ধে মানুষের কোনও ভ্যাকসিন নেই, তাই এই রোগের প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের প্রতি বেশি জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া আক্রান্ত পশুর চিকিৎসা করানোর ওপরও জোর দেয়া হয়েছে।

কারা বেশি ঝুঁকিতে?

ব্রুসেলোসিস বিশ্বব্যাপী শনাক্ত হয়েছে এবং সবখানেই এটি একটি নিরাময়যোগ্য রোগ। এই রোগ নারী পুরুষ নির্বিশেষে যে কোনও বয়সের মানুষের হতে পারে।

সাধারণ যাদের মধ্যে কাঁচা দুধ বা কাঁচা দুধের তৈরি খাবার খাওয়ার প্রবণতা বেশি তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।

কৃষক, খামারি, কসাই, শিকারি, পশু-চিকিৎসক অর্থাৎ যারা পশু নিয়ে কাজ করেন এবং পশুর রক্ত, প্ল্যাসেন্টা, ভ্রূণ এবং জরায়ুর স্রাবের সংস্পর্শে থাকেন তাদের জন্যও এই রোগটিকে পেশাগত বিপদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, মধ্যপ্রাচ্য,পূর্ব ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা মেক্সিকো, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা, আবার ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশ যেমন পর্তুগাল, স্পেন, দক্ষিণ ফ্রান্স, ইতালি, গ্রীস, তুরস্কে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে