কেটে গেলে সহজে রক্তপাত বন্ধ হয় না, রোগটি সম্পর্কে জেনে নিন

0
338
Spread the love

প্রতিবছর ১৭ এপ্রিল হিমোফিলিয়া রোগ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস’ উদযাপন করা হয়ে থাকে। রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টিকারী এই রোগটির কারণে শরীরের কোথাও কেটে গেলে রক্তপাত সহজে বন্ধ হয় না। মেয়েরা সাধারণত এই রোগে আক্রান্ত হয় না, এ রোগের বাহক হয়। এ রোগ এবং এর প্রতিকার সম্পর্কে ধারণা থাকলে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে অনাগত শিশুকে রেহাই দেওয়া সম্ভব।

হিমোফিলিয়া একটি বংশানুক্রমিক জিনগত রোগ। রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টিকারী এই রোগটির কারণে শরীরের কোথাও কেটে গেলে রক্তপাত সহজে বন্ধ হয় না। এই রোগ সম্পর্কে জানাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সালাহ্উদ্দীন শাহ্

হিমোফিলিয়া কী?

হিমোফিলিয়া একটি বংশানুক্রমিক জিনগত রোগ। যাকে বলা হয় X linked recessive disorder। বিশ্বে প্রতি ১০ হাজারে একজন এই রক্তক্ষরণ রোগে ভুগছে আর তাদের ৭৫ শতাংশ রোগী সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। এই রোগে রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়, তাই শরীরে কোথাও কেটে গেলে আর রক্তপাত বন্ধ হয় না। X ক্রমোজমে F8 ও F9 নামক জিন থাকে, যা ফ্যাক্টর-৮ (F-VIII) ও ফ্যাক্টর-৯ (F-IX) ক্লোটিং প্রোটিন তৈরি করে। এই ক্লোটিং প্রোটিন রক্তের সাদা অংশে পরিমাণমতো থাকে। ফলে শরীরের কোথাও কেটে গেলে রক্তক্ষরণ আপনাআপনিই বন্ধ করতে এই ফ্যাক্টরগুলো কাজ করে। আর এই প্রোটিন কম পরিমাণ থাকলে কোথাও কেটে গেলে রক্তপাত সহজে বন্ধ হয় না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এই রোগকে বলা হয় হিমোফিলিয়া। হিমোফিলিয়া সাধারণত দুই প্রকার। যথা—হিমোফিলিয়া ‘এ’ ও হিমোফিলিয়া ‘বি’।

লক্ষণ

হিমোফিলিয়া রোগে কেউ আক্রান্ত কি না তা লক্ষণ দেখলেই কিছুটা বোঝা যায়। যেমন—কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে রক্তক্ষরণ, শরীরের কোথাও আঘাত লাগলে সেই জায়গাটি নীলচে হয়ে ফুলে যায় অর্থাৎ চামড়ার নিচে রক্তক্ষরণ; মাংসপেশিতে এবং অস্থিসন্ধিতে রক্তক্ষরণ; হাঁটু, কনুই ও অন্যান্য অস্থিসন্ধি ফুলে যাওয়া; শরীরের কোথাও কেটে গেলে দীর্ঘক্ষণ রক্ত ঝরা; দাঁত তোলার পর বা সুন্নতে খতনা করার পর রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়া, শিশু হামাগুড়ি দেওয়ার সময় হাঁটুতে কালচে দাগ হওয়া, নবজাতকের নাভি কাটার সময় দীর্ঘক্ষণ রক্তক্ষরণ হওয়া ইত্যাদি।

পুরুষ অথবা নারী উভয়েই কি এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে?

সাধারণত শুধু পুরুষ লোক এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং নারীরা এই রোগের বাহক। কারণ নারীদের দুটি এক্স (XX) ক্রমোজম থাকে আর পুরুষদের থাকে একটি এক্স (X) ও অপরটি ওয়াই (Y) ক্রমোজম। ছেলেদের যেহেতু একটি X ক্রমোজম থাকে এবং এই X ক্রমোজমটি যদি অসুস্থ/defect হয়, তাহলে F-VIII ও F-IX তৈরি হয় না। ফলে ছেলেরাই এই রোগে আক্রান্ত হয়। আর মেয়েদের যেহেতু দুটিই X ক্রমোজম, তাই একটি X ক্রমোজম যদি অসুস্থ বা ডিফেকট থাকেও অন্য আরেকটি X সুস্থ থাকার ফলে F-VIII ও F-IX তৈরি হয়। তাই মেয়েরা সাধারণত এই রোগে আক্রান্ত হয় না, এ রোগের বাহক হয়। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে নারীরাও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যেমন—lionization/inactivation of healthy X chromosome থাকলে, বাবা রোগী ও মা বাহক হলে অথবা Turner syndrome (45, XO) হলে মেয়েরাও রোগী হতে পারে। তাই হিমোফিলিয়া রোগীর সঙ্গে নিকটাত্মীয়, যেমন—খালাতো, মামাতো বা ফুপাতো বোনের বিয়ে হলে দুজনেই রোগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

এই রোগটি কি শুধুই বংশানুক্রমিক?

হিমোফিলিয়া রোগে শুধু বংশানুক্রমিকভাবে আক্রান্ত হয় এমন নয়, বংশানুক্রমিক সঞ্চারিত না হয়েও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি তিনজন হিমোফিলিয়া রোগীর মধ্যে অন্তত একজন রোগী বংশানুক্রমে সঞ্চারিত না হয়ে নতুনভাবে আক্রান্ত হয়।

বাংলাদেশে এই রোগীর সংখ্যা কত?

বাংলাদেশে কতসংখ্যক হিমোফিলিয়া রোগী আছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বিশ্ব জরিপে দেখা যায়, বিশ্বে প্রতি ১০ হাজারে একজন হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। সে হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার হওয়ার কথা থাকলেও দেশীয় এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রায় ৩০০০-৪০০০ রোগী নিয়মিতভাবে চিকিৎসাসেবার আওতায় আছে।

বিশ্বে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা কত?

ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব হিমোফিলিয়া কর্তৃক ২০২০ সালে ১২০টি দেশে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, বিশ্বে প্রতিবছর ১৩০ মিলিয়ন শিশু জন্মগ্রহণ করে, যার মধ্যে ২০ হাজার শিশু জন্মগতভাবে হিমোফিলিয়া নিয়ে জন্মায়। এই ২০ হাজারের মধ্যে সাত হাজার শিশু মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়। বিশ্বে হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। যদিও সারা বিশ্বে এর প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি। কেননা বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই হিমোফিলিয়ার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। যাঁরা চিকিৎসাসেবার আওতায় আছেন তাঁদের মাধ্যমে মূলত এই পরিসংখ্যান করা হয়েছে।

বংশানুক্রমে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কতটুকু?
♦ যদি বাবা সুস্থ এবং মা বাহক হয়, তবে ছেলেসন্তানের রোগী হওয়ার আশঙ্কা ৫০ শতাংশ, আর মেয়েসন্তানের বাহক হওয়ার আশঙ্কা ৫০ শতাংশ।

♦ যদি বাবা রোগী এবং মা সুস্থ হন, তবে সব ছেলেসন্তানই সুস্থ হবে এবং সব মেয়েসন্তানই বাহক হবে। সুতরাং প্রত্যেক হিমোফিলিয়া পুরুষ রোগী বিয়ে করতে পারবেন, তবে সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

♦ যদি বাবা রোগী এবং মা বাহক হন, তবে ছেলেসন্তানের রোগী হওয়ার আশঙ্কা ৫০ শতাংশ। আর মেয়েসন্তানের রোগী হওয়ার আশঙ্কা ২৫ শতাংশ ও বাহক হওয়ার আশঙ্কা ২৫ শতাংশ।

চিকিৎসা
সামান্য অসাবধানতায় মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে বিধায় এই রোগে আক্রান্ত রোগীকে নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক চলতে হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা, ক্রাইয়োপ্রেসিপিটেট পরিসঞ্চালন করতে হয়। F-VIII ও F-IX—যা এই রোগীদের শরীরে তৈরি হয় না, সেগুলো ইনজেকশনের মাধ্যমে নিতে হয়। এসব ইনজেকশন অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ফলে হিমোফিলিয়া রোগের চিকিৎসা করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়, যা বাংলাদেশের বেশির ভাগ রোগীরই সামর্থ্যের বাইরে। তাই সময়মতো যথাযথ চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে না পারার কারণে অনেক বাবা-মা অকালে তাঁদের সন্তান হারান।

হিমোফিলিয়া রোগ থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে মুক্তির কোনো উপায় আছে কি?
হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীর পূর্ণাঙ্গ রোগ মুক্তির ক্ষেত্রে জিনথেরাপির বিষয়টা গবেষণায় রয়েছে এবং উন্নত দেশগুলোতে জিনথেরাপি সফলভাবে সম্পন্ন করা হচ্ছে। কিন্তু স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখনো জিনথেরাপি চালু হয়নি।

প্রতিরোধ
হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত রোগী যত দিন বেঁচে থাকে তত দিন চিকিৎসার মধ্যে থাকলেও স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন যাপন করতে পারেন না। তাই এই রোগ প্রতিরোধের জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি। হিমোফিলিয়া কী, এই রোগের কারণগুলো এবং প্রতিকার ও প্রতিরোধের বিষয় সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান থাকলে অনাগত শিশুরা এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে। প্রত্যেকটি মানুষের বিয়ের আগে কাউন্সেলিং, জেনেটিক পরীক্ষা করতে পারলে এবং সেই অনুযায়ী বিয়ে হলে এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। অথবা বিয়ে করার পর যদি এই রোগ ধরা পড়ে, তবে গর্ভধারণকালীন প্রি-নাটাল ডায়াগনসিস করে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন যে অনাগত শিশুটি হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত কি না। অর্থাৎ এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা থাকলে এই রোগ অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। যদিও এই রোগ শুধু যে বংশানুক্রমিকভাবেই সঞ্চারিত হয় তা নয়, অন্যভাবেও এই রোগ হতে পারে। তাই এই রোগ সম্পর্কে জানা থাকাটা জরুরি।

হিমোফিলিয়া রোগীদের অবশ্য পালনীয় বিষয়গুলো কী কী?

♦ নিয়মিত রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া।

♦ হিমোফিলিয়া ট্রিটমেন্ট সেন্টারে নিবনন্ধন করে নিয়মিত চিকিৎসাসেবার আওতায় থাকা।

♦ আঘাত পাওয়ার আশঙ্কা আছে এমন কাজ বা খেলাধুলা না করা।

♦ মাংসে ইনজেকশন না দেওয়া।

♦ রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ/বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত ছোট থেকে বড় কোনো ধরনের অস্ত্রোপচার না করা।

♦ Anticoagulants (Heparin, Warfarin), NSAIDs ( Aspirin, Naproxen etc) গ্রহণ না করা।

♦ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথার ওষুধ গ্রহণ করা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে