চার কোটি কিডনি রোগী চিকিৎসা অপ্রতুল

0
1
Spread the love

দেশে মোট মৃত্যুর ৭০ ভাগই হয় অসংক্রামক ব্যাধি তথা কিডনি ফেইলর, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ ও ক্যানসারে মতো রোগে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা যায় কিডনি বিকল হয়ে। দেশে বর্তমানে ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ কিডনির সমস্যায় ভুগছেন। প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার রোগী ডায়ালাইসিসের ওপর নির্ভরশীল হন এবং কিডনি বিকল হয়ে মারা যান। আরও ২৪ থেকে ৩০ হাজার রোগীর হঠাৎ কিডনি বিকল হয়। এই রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তবে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করে চিকিৎসা নিলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ সম্ভব বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রতিবছর মার্চের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার কিডনি দিবস পালিত হয়। এ ধারাবাহিকতায় আজ ১৩ মার্চ পালিত হচ্ছে বিশ্ব কিডনি দিবস-২০২৫। ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব নেফ্রোলজি (আইএসএন) নির্ধারিত এবারের প্রতিপাদ্য-‘আর ইয়োর কিডনিস ওকে? ডিটেক্ট আরলি, প্রটেক্ট কিডনি হেলথ’ অর্থাৎ আপনার কিডনি ঠিক আছে কি? তাড়াতাড়ি পরীক্ষা করুন, কিডনির স্বাস্থ্য রক্ষা করুন।’ প্রতিপাদ্যে কিডনির সুরক্ষার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও কিডনি ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক হারুন-উর-রশিদ যুগান্তরকে বলেন, কিডনি রোগের প্রধান তিনটি কারণের মধ্যে প্রথম ডায়াবেটিস, দ্বিতীয়ত উচ্চরক্তচাপ এবং তৃতীয় কারণ নেফ্রাইটিস সিম্পট্রোম। দেশে নেফ্রাইটিস দিন দিন কমলেও অসংক্রামক রোগ ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপের রোগী বাড়ছে।

তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যবশত ৫০ থেকে ৬০ ভাগ রোগী জানেন না তাদের শরীরে ডায়াবেটিস এবং ৫৫ থেকে ৬৫ শতাংশ রোগী জানেন না যে উচ্চরক্তচাপ আছে। যথাসময়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন না। যখন পরীক্ষা করা হয় ততক্ষণে ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ কিডনি কার্যকারিতা হারায়। কিডনি বিকল প্রতিরোধে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা দরকার।

দেশে কিডনিবিষয়ক বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস)। সংস্থাটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. এমএ সামাদ বলেন, বিশ্বে প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ শুধু দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। এই সংখ্যা ডায়াবেটিক রোগীদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ এবং ক্যানসার রোগীর চেয়ে প্রায় ২০ গুণ। মৃত্যুর কারণ হিসাবে কিডনি রোগ ১৯৯০ সালে ছিল ১৯তম স্থানে, বর্তমানে দাঁড়িয়েছে সপ্তম স্থানে। এভাবে চলতে থাকলে ২০৪০ সালে চলে আসবে পঞ্চম স্থানে। উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশে কিডনি রোগের হার সবচেয়ে বেশি।

ডা. এমএ সামাদ বলেন, কিডনি রোগের ব্যাপকতা, ভয়াবহতা, পরিণতি ও কারণ সম্পর্কে সচেতন হলে, স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করলে শতকরা ৬০-৭০ ভাগ ক্ষেত্রে কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব। এজন্য আগে যাদের কিডনি রোগের ঝুঁকি আছে, তাদের বছরে অন্তত দুইবার প্রস্রাব ও রক্তের ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা করা উচিত।

আইএসএন দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক চেয়ার অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রফিকুল আলম যুগান্তরকে বলেন, অনেক ডায়াবেটিস রোগী ব্লাড সুগার এবং হাইপারটেনশন (উচ্চরক্তচাপ) স্বাভাবিক থাকলেই আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন। রিপোর্ট দেখে চিকিৎসকরাও রোগীর প্রস্রাবে অ্যালবুমিন যাচ্ছে কিনা বলেন না। এজন্য সবার আগে স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম চালু করে রোগটি প্রতিরোধ এবং রোগীদের জন্য ডায়ালাইসিস সেবা বাড়াতে হবে। ওষুধের দাম কমানো ও কিডনি প্রতিস্থাপন বাড়াতে ইমোশনাল ডোনারদের কিডনি দানে আইনি বাধা দূর করতে হবে।

বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সচিব ডা. ফরহাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, কিডনি রোগের প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতি হলো ডায়ালাইসিস এবং ট্রান্সপ্লান্ট (কিডনি প্রতিস্থাপন)। দেশে ডায়ালাইসিস সেবা খুবই অপ্রতুল। বর্তমানে ৩০টি সরকারি প্রতিষ্ঠানে ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা আছে। সরকার ৪৪টি জেলা সদর হাসপাতালে ১০ শয্যা এবং ২২টি মেডিকেল কলেজে ৫০ শয্যা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে একজন এবং জাপানে প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যার জন্য ৩০ জন কিডনি চিকিৎসক রয়েছেন। অন্যদিকে দেশে গড়ে ৬ লাখ মানুষের জন্য রয়েছেন একজন। সরকারি হাসপাতালে কিডনি বিশেষজ্ঞ আছেন ৯৫ জন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন ২৬০ জন বিশেষজ্ঞ। সারা দেশে সরকারিভাবে কিডনি কনসালটেন্ট চিকিৎসক আছেন মাত্র ৭ জন এবং সিনিয়র কনসালটেন্ট আছেন দুজন। বর্তমানে ৬টি সরকারি ইনস্টিটিউটে নেফ্রোলজি বিষয়ে এমডি কোর্স চালু আছে। এছাড়া নেফ্রোলজি অধ্যাপকের ১২টি পদের মধ্যে ৫টি ফাঁকা রয়েছে। ডায়ালাইসিসের জন্য ৩০ জনের মতো টেকনিশিয়ান থাকলেও বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এনসিডিসি লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. সৈয়দ জাকির হোসেন বলেন, আক্রান্তদের কিডনি চিকিৎসায় জাতীয় গাইডলাইন করা হয়েছে। আরও কিছু কাজ চলমান আছে। সম্প্রতি জেলা প্রশাসক সম্মেলনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আলোচনা পর্বে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে ডিসিদের নির্দেশ দিয়েছেন।

দিবসের আয়োজন : এদিকে বিশ্ব কিডনি দিবস উপলক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারিভাবে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। আজ জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট, বিএসএমএমইউতে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। আন্তর্জাতিক কিডনি দিবস ও মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বেসরকারি ইনসাফ বারাকাহ কিডনি অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল মাসব্যাপী ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করেছে। ক্যাম্পে চিকিৎসকরা বিনামূল্যে রোগীদের চিকিৎসা পরামর্শ দেবেন। কিডনি সম্পর্কিত সিরাম ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা বিনামূল্যে করা হবে। ১২০০ টাকায় ৫টি পরীক্ষা প্যাকেজে (আল্ট্রাসনোগ্রাম, ইসিজি, সিবিসি, ইউরিন আরই এবং সিরাম ক্রিয়েটিনিন) হেলথ চেকআপ করবে। পাঁচজন হতদরিদ্র রোগীকে এক বছর পর্যন্ত ওষুধ ছাড়া বিনামূল্যে ডায়ালাইসিস করা হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে