দেশে ভারতীয় ভেরিয়েন্ট শনাক্ত: ঈদের পরে সংক্রমণ তীব্র হওয়ার শঙ্কা

0
899
Spread the love

স্বাস্থ্যবিধি না মেনে গত কয়েক দিনে যেভাবে ঈদের কেনাকাটা করতে মানুষ ভিড় করছে, গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে পথে পথে ঢল নেমেছে লাখো মানুষের, তাতে আতঙ্কিত হয়ে বারবার সতর্কবার্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন সরকার ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

বেশি সতর্ক করা হচ্ছিল প্রতিবেশী ভারতে সংক্রমিত করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভেরিয়েন্টের বিষয়ে। বলা হচ্ছিল এই ভেরিয়েন্ট দেশে ঢুকলে বিপদ অনেক বেশি হবে। বলতে বলতেই ভারতীয় ভেরিয়েন্ট এরই মধ্যে ঢুকে পড়েছে দেশে। তাতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও বেড়ে গেছে। পরিস্থিতির মুখে যেকোনো সময় আবার মার্কেট ও দোকানপাট সব বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে বলে গতকাল সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একটি সূত্র জানিয়েছে। জাতীয় বিশেষজ্ঞ কমিটির নেতারাও সরকারকে এমন পরামর্শ দিতে যাচ্ছেন।

করোনার বিস্তার ঠেকাতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনার ভিত্তিতে দেশে চলছে ‘লকডাউন’ পরিস্থিতি। জীবন-জীবিকার স্বার্থে শর্ত সাপেক্ষে কিছুটা শিথিল পদক্ষেপও রাখা হয়েছে। এক জেলা থেকে যাতে অন্য জেলায় সংক্রমণ ছড়াতে না পারে সে জন্য দূরপাল্লার জনবহুল যোগাযোগমাধ্যমগুলো বন্ধের নির্দেশনা রয়েছে। দেশের বাইরে থেকে দেশে সংক্রমণ ঠেকানোর লক্ষ্যে সীমান্ত বন্ধ করা হয়েছে। ব্যবসায়ী ও পরিবহন সেক্টরের দাবির মুখে মার্কেট-দোকানপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। চালু করা হয়েছে জেলা বা মহানগরীর ভেতরে গণপরিবহন। সব ক্ষেত্রে শর্ত রয়েছে স্বাস্থ্যবিধি মানার। কিন্তু দৃশ্যত সব শর্ত ভেঙে ঈদের কেনাকাটায় যেমন মানুষের ঢল নেমেছে, ঢল নেমেছে ঢাকা থেকে গ্রামের উদ্দেশে মানুষের যাতায়াতেও।

তাতেও ক্ষান্ত হচ্ছেন না পরিবহন সেক্টরের ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। রীতিমতো হুমকি-ধমকি দিয়ে বাকি সব পরিবহন চালুর জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। পরিস্থিতির মুখে একদিকে অসহায় হয়ে পড়েছেন দেশের স্বাস্থ্য প্রশাসন ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সবাই হতবাক মানুষের অসচেতন ও বেপরোয়া আচরণে। প্রতিদিন বারবার নানাভাবে সতর্ক করলেও কেউ যেন কথা কানে দিচ্ছে না। ফলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, জাতীয় বিশেষজ্ঞ কমিটি, সরকারি বেসরকারি পর্যায়ের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সবাই বলছেন সতর্ক না হলে ঈদের পরে চরম খারাপ পরিণতি ঘটতে পারে। আগের চেয়েও চূড়ায় উঠে যেতে পারে সংক্রমণ, লাফিয়ে উঠতে পারে মৃত্যু, যা সামাল দেওয়ার সক্ষমতা বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেরও নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। সংক্রমণ ঠেকাতে হলে মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়া এবং টিকা দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এর আগে গতকাল তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ভারত থেকে আসা মানুষের মধ্য থেকে আটজনের নমুনা পরীক্ষা করে ছয়জনের মধ্যে ভারতীয় ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। তবে এর মধ্যে দুটিতে শতভাগ এবং বাকী চারটিতে ভারতীয় ভেরিয়েন্টের অংশ বিশেষ উপস্থিতি রয়েছে। আক্রান্তরা সবাই বেনাপোল দিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন, তারা সবাই বাংলাদেশি। তবে কিছুদিন আগে ভারত থেকে দেশে ঢুকে যারা হাসপাতাল থেকে পালিয়েছেলেন তাদের নমুনায় তা ধরা পড়েনি।

এদিকে দেশে ঈদ মার্কেটিং ও বাড়িমুখে মানুষের ভিড় দেখে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, যা দেখছি—খুবই দুঃখজনক। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ঈদের পড়ে সংক্রমণ, মৃত্যু ঠেকানো বা হাসপাতালে রোগীর চাপ সামাল দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। মানবিক বা অর্থনৈতিক কারণে সরকার শর্তসাপেক্ষে যেটুকু শিথিল-সুযোগ দিয়েছে সেগুলোর চরম অপব্যবহার ঘটছে। দোকান মালিক কিংবা পরিবহন খাতের লোকজন যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে কিংবা শর্ত মেনে দোকান চালুর অনুমতি নিয়েছেন সরকারের কাছ থেকে, কিংবা শহরের মধ্যে পরিবহন চালাচ্ছেন সেগুলোর কোনো কিছুই পালন করা হচ্ছে না। ক্রেতাও বেপরোয়া হয়ে ঢলের মতো ছুটছেন দোকানে, মার্কেটে, ঢাকার বাইরে।

সরকারের সর্বোচ্চ পরামর্শক কমিটির ওই চেয়ারম্যান বলেন, এখন প্রয়োজনে আবার সব কিছু বন্ধ করে দিতে হবে। আমরা সরকারকে সেই পরামর্শ দেবো। কারণ ইতিমধ্যেই দেশে ভারতীয় ভেরিয়েন্ট ঢুকে পড়েছে। এটা যুক্তরাজ্য, চীন, ইতালি কিংবা সাউথ আফ্রিকান ভেরিয়েন্টের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত ছড়াতে সক্ষম। তিনি বলেন, আমরা খুবই উদ্বিগ্ন ঈদের পরের কি পরিণতি হবে সেই আশংকায়।

ওই উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে যাদের দায়িত্ব পালন করার কথা তাঁরা কেনো দায়িত্ব পালন করছে না সেটা রহস্যজনক। কিভাবে ঢাকা থেকে লাখ লাখ মানুষ বের হয়ে ফেরি ঘাটে গিয়ে ভিড় করলো সেটা তদন্ত করা দরকার। কেনো ঢাকা থেকে বের হওয়ার পয়েন্টে তাদেরকে আটকে দেওয়া হল না। বের হওয়ার সময় বাধা দিলে এই মানুষগুলো সহজে যার যার বাসায় ফিরে যেতে পারতো, দুর্ভোগ হতো না। এখন ফেরি ঘাটে এক অমানবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সেখানে লাখ লাখ মানুষ আরো বিপদে পড়েছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে ফেরিঘাটে জরুরি ত্রান পাঠানো দরকার, না হলে সেখানে আটকেরা নারী শিশু বয়স্কদের আরো বিপর্যয় ঘটতে পারে। তিনি বলেন, যে কোনো মূল্যে স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে। প্রশাসনকে সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থায় যেতে হবে আসন্ন বিপদ থেকে সবাইকে রক্ষা করতে হলে। প্রয়োজনে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সেনাবাহিনী নামানো যেতে পারে।

করোনার কারনে ভারতের সাথে সীমান্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর গত ২৬ এপ্রিল থেকে আটকে পড়া বাংলাদেশীরা বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেশে ফিরছেন। গত ৪ মে পর্যন্ত বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে এক হাজার ৫৭৭জন দেশে ফিরেছেন। যাদের বেনাপোলসহ যশোর জেলা ও পার্শ্ববর্তী চার জেলার হোটেলসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি স্থাপনায় কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে ১৬জন করোনা পজেটিভ যাত্রীর নমুনা সংগ্রহ করে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জোনাম সেন্টারের পিসিআর ল্যাবে পরীক্ষায় পাঠানো হয়। এর মধ্যে তিনজনের নমুনা পজেটিভ আসে। এ তিনজনের মধ্যে দুজনের শরীরে করোনার ভারতীয় ভেরিয়েন্টের অস্তিত্ব মেলে। জোনাম সেন্টারের সহযোগী পরিচালক প্রফেসর ড. মো. ইকবাল কবীর জাহিদ বলেন, ‘ভারতীয় ভেরিয়েন্টের নম্বর হলো বি ১.৬ ১৭.২। তবে এটি ডাবল মিউট্যান্ট নয়। ভারতের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ এ ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত। তারপরও এ ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ রোধে সতর্ক হতে হবে।’

উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, যে দুজনের নমুনায় ভারতীয় ভেরিয়েন্ট মিলেছে তাদের নমুনার পুরোপুরি জিনোম সিকোয়েন্স করার উদ্যোগ নিয়েছি। যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. দিলিপ কুমার রায় বিকেল পৌনে ৪ টার দিকে সাংবাদিকদের বলেন, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোম সেন্টারে ও আইইডিসিআরএ নমুনা পাঠানো হয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে