উচ্চ রক্তচাপ বা হাইব্লাড প্রেশার নামটা আমাদের কাছে সমধিক পরিচিত। একবিংশ শতাব্দীর এক নম্বর নীরব ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে এই ব্যাধিকেই। সেকাল থেকেই উত্তরের জনপদকে অবিহিত করা হতো আয়োডিনের অভাব অথবা আয়োডিন স্বল্পতা হিসেবে, অবশ্য কারণটাও যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। আয়োডিনের অভাবজনিত কারণে গলগণ্ডের প্রাদুর্ভাব ছিল লক্ষনীয়। গলগণ্ডের সমস্যা এখন অনেকটাই সমাধান হয়েছে তবে সমস্যাটা ভিন্ন জায়গায়।
সমুদ্র কিংবা সামদ্রিক মাছের সঙ্গে খুব একটা পরিচিতি নেই উত্তরের তিস্তা বিধৌত জনপদের। এখানে বন্যা হয়, খরার তীব্রতাও কম নয়। কোনো অংশে এখানে আয়োডিন হারায় বন্যার পানিতে কিংবা উচ্চ তাপমাত্রার রান্নায়। আর আপনি দায়ী করলেন উত্তরের জনপদকে? এবার কাজের কথায় আসা যাক, আয়োডিন বেশি থাকে সামুদ্রিক মাছে, সেটা হোক শুটকি কিংবা টাটকা মাছ। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমে বিস্তীর্ণ হাওর এলাকা বিদ্যমান, এখান থেকে দেশের অধিকাংশ এলাকায় মাছ ও প্রক্রিয়াজাত মাছ ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশের আনাচে-কানাচে, তবে সবচেয়ে সহজলভ্য এবং প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে কিউরিং বা শুটকি এতে করে যেমন অতিরিক্ত লবণ যুক্ত হচ্ছে সেই সঙ্গে বাড়ছে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি। যদি কিউরিংয়ে আধুনিকায়নের ছোঁয়া লাগে তাহলে ওই সমস্যা থেকে আশু মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
সাম্প্রতিককালে আয়োডিন যুক্ত লবণ এক রমরমা ব্যবসার আরেক নাম। আয়োডিনের স্বল্পতা জনিত উপসর্গ থেকে নিস্তার পেতে ১৯৮৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১২০টি দেশে লবণের সঙ্গে আয়োডিন সম্পূরক খাদ্য হিসেবে যুক্ত করার তাগিদ দেন, অথচ সেটার বাস্তব প্রয়োগ কতখানি তা আমাদের সামনেই দৃশ্যমান।
বাজারে আয়োডিন যুক্ত লবণের বিজ্ঞাপনে সয়লাব, কিন্তু আয়োডিনের মাত্রা নিয়ে আমরা সন্দিহান, প্যাকেটের গায়ে ‘আয়োডিন যুক্ত লবণ’ লেখা থাকলেও ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় বাজারের বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের লবণে আয়োডিন অনুপস্থিত। অথচ প্রতি প্যাকেট লবণে আয়োডিন যুক্ত করতে খরচ গুনতে হয় মাত্র ২৫ পয়সা।
আপনাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য থেকে বাঁচতে গিয়ে সবাই ঝুঁকে পড়ল আয়োডিন যুক্ত লবণের ওপর। লবণ খেয়ে গলগণ্ড নামক রোগের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে লবণ খাওয়া শুরু করেছে, পরিত্রাণও মিলেছে অনেকটাই।
ঠিক তখনি উচ্চ রক্তচাপ বাসা বাধঁতে শুরু করেছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘হাইপারটেনশন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট’। অধ্যাপক ডা. জাকির হোসেন নামের আলোর ফেরিওয়ালা নিজ উদ্যোগে উত্তরের জনপদের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নের জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এই একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানের জন্যই অনেকে বাঁচতে শিখেছেন, নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি স্বাস্থ্য তথ্য প্রদান করা হয়ে থাকে এখানে।
একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের যেখানে আয়োডিনের দৈনিক চাহিদা ১৫০ মাইক্রোগ্রাম যা অতি সামান্য বা ট্রেস এলিমেন্ট সেখানে সোডিয়ামের দৈনিক গড় চাহিদা ৫ গ্রামেরও কম এবং যার পরিমাণ প্রায় এক চা চামচেরও কম। আমরা হালের ফ্যাশন হিসেবে লবণ খাওয়ার যে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে গেছি, হরহামেশাই লবণ বেশি খাওয়া হয়ে যাচ্ছে, অম্লান বদনেই পাতে লবণ খাওয়া চলছেই।
ঘরের রান্না করা তরকারি থেকে শুরু করে, রাস্তার মোড়ের পেয়ারা মাখা, আনারস মাখাতেও লবণ খেতে ছাড়ছি না, যার দরুন কম বয়সের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেড়েই চলেছি প্রতিনিয়ত। আয়োডিনের লোভে পড়ে যে হারে লবণ এবং লবনজাত খাবারের পরিধি বেড়ে চলেছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
আয়োডিনের ঘাটতি পূরণে মুখে খাওয়ার আয়োডিনের পাশাপাশি ইনজেকশনও পাওয়া যায়। তাই আয়োডিনকে সম্পূরক খাদ্য হিসেবে লবণে যুক্ত করার পাশাপাশি অন্যন্য খাবারেও আয়োডিন যুক্ত করা নিয়ে ভাববার সময় এসেছে, এছাড়া দুর্দিনের প্রহর গুনতে হবে গোটা জাতিকে।
লেখক: মো. আবদুল করিম
এমবিবিএস পঞ্চম বর্ষ, রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ।