সুস্থ শরীরের জন্য মিনারেল

0
190
Spread the love

সুস্থ শরীরের জন্য খাদ্যের মধ্যে ‘খনিজ পদার্থ’ বা ‘মিনারেল’ সঠিক মাত্রায় বিদ্যমান থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অজৈব উপাদানে গঠিত এই খনিজ পদার্থগুলো নিজেদের মধ্যে ও অন্যান্য ভিটামিন ও এনজাইমের সঙ্গে সহযোগী হিসেবে কাজ করে জীবনের জন্য অপরিহার্য শরীরস্থ বিভিন্ন কোষকলার শরীরবৃত্তীয় ও প্রাণরসায়ন সংক্রান্ত লাখ লাখ বিক্রিয়া এবং প্রক্রিয়াগুলো ঘটাতে সাহায্য করে যা শারীরিক গঠন ও বৃদ্ধি, শক্তি উৎপাদন, গতিময়তা এবং শরীরবৃত্তীয় বিভিন্ন কর্মকা- পরিচালনা এবং সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য।

তবে শরীর সাধারণত কোনো একটি খনিজকে একক বা আলাদাভাবে ব্যবহার না করে সবধরনের খনিজপদার্থ, ভিটামিন এবং এনজাইমের পরস্পরের সঙ্গে সংঘটিত বিক্রিয়া সৃষ্ট ফলাফলকেই গ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরে নেয়। যেমন- ক্যালশিয়াম শক্তিশালী হাড় গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এক্ষেত্রে ম্যাগনেশিয়াম এবং ফসফরাসেরও যথেষ্ট ভূমিকা আছে। তাই এগুলোর মধ্যে যে কোনো একটি উপাদানের অভাব বা অপর্যাপ্ততা শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। পুষ্টিকর খাদ্যের এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণই হওয়া উচিত খনিজ পদার্থ।
খনিজ পদার্থগুলোকে ম্যাক্রো একং মাইক্রো এ দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। শরীরের জন্য ম্যাক্রোমিনারেলগুলোর প্রয়োজনীয়তা কিছুটা বেশি যা দিনে ১০০ মিলিগ্রাম বা তার উপরে। আর মাইক্রোমিনারেল যেগুলোকে ‘ট্রেস এলিমেন্ট’ও বলা হয় সেগুলোর প্রয়োজনীয়তা মাইক্রোগ্রাম স্কেলে হয়।

ক্যালসিয়াম : হাড়, দাঁত ও নখের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা ছাড়াও ক্যালসিয়াম রক্ত জমাট বাঁধা, কোনো কোনো এনজাইমের কার্যক্রম পরিচালনা, দেওয়াল ভেদ করে কোষকলায় প্রবেশকৃত তরল ও বায়বীয় পদার্থের সঞ্চালনকে নিয়ন্ত্রণ, হৃৎপি-স্থ মাংসপেশির সংকোচন ও হৃৎপি-ের স্বাভাবিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ, স্নায়ু সঞ্চালন ও সংকেত আদান-প্রদানসহ বিভিন্ন জৈবিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।

ফসফরাস : এটি শর্করা, চর্বি ও আমিষ জাতীয় উপাদানগুলোর শরীরবৃত্তীয় বিপাকীয় প্রক্রিয়া পরিচালিত করতে, স্নায়ু ও মস্তিষ্কের কোষকলা গঠনে, ক্যালসিয়ামের সঙ্গে যৌথভাবে হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাহায্য করে। মাংসপেশি সংকোচনে সাহায্য করে বলে এটি হৃৎপিণ্ডকে সচল রাখতে ভূমিকা রাখে। অন্য যে কোনো উপাদানের তুলনায় এটি শরীরবৃত্তীয় বিভিন্ন বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

পটাশিয়াম : শরীরস্থ বিভিন্ন তরলের ভারসাম্য রক্ষায়, মাংসপেশি সংকোচন এবং স্নায়ুস্থ ঘাত-প্রতিঘাত সঞ্চালন ও কর্মপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ, কোষকলাস্থ বিষাক্ত পদার্থ অপসারণ এবং সেগুলোর মধ্যে পুষ্টি সরবরাহের ক্ষেত্রে এই উপাদানটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন, কোষকলার স্থিতিস্থাপকতা, লিভার এবং মস্তিষ্কের সঠিক কর্মক্ষমতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

সোডিয়াম : পটাশিয়ামের সঙ্গে সঙ্গে সোডিয়ামও মাংসপেশি সংকোচন এবং স্নায়ুস্থ ঘাত-প্রতিঘাত সঞ্চালনে এবং শরীরস্থ বিভিন্ন তরলের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। স্নায়ুর কার্যক্রম সঠিক পরিচালনায়, পরিপাকে সহায়ক প্রয়োজনীয় খাদ্যরস সরবরাহ এবং শরীর থেকে বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনে সোডিয়াম বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

ম্যাগনেশিয়াম : ডিএনএ-এর সংশ্লেষণসহ শরীরের প্রায় ৩০০টি জৈব-বিক্রিয়া ঘটানোর ক্ষেত্রে এবং শর্করা বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় এই উপাদানটির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পর্যায়ভুক্ত হওয়ায় এটি রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক।

সালফার : এটি ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএ-এর পুনর্গঠনে এরং খাদ্য বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে, কোষকলাকে ক্যান্সারসহ অন্যান্য জটিল রোগের হাত থেকে রক্ষা করে, ত্বক, পেশিবন্ধনী  (টেন্ডন) ও অস্থিবন্ধনীকে (লিগামেন্ট) সুরক্ষা করে।

ক্লোরিন : এই খনিজটি শরীরস্থ তরল ও বায়বীয় পদার্থসমূহ নিয়ন্ত্রণে, পাকস্থলীস্থ বিভিন্ন ঝিল্লির মধ্যে বৈদ্যুতিক নিষ্ক্রিয়তা বজায় রাখতে এবং শক্তিশালী একটি পরিপাকীয় এনজাইম হাইড্রোক্লোরিক এসিড উৎপাদনে সহায়তা করে। এটি ধাতব খনিজ পদার্থসমূহ পরিপাকে, ভিটামিন বি-১২ শোষণে, রক্তস্থ সঠিক পিএইচ মাত্রা নিয়ন্ত্রণে, কার্বন-ডাই-অক্সাইড সঞ্চালনে, হৃৎপি-ের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

আয়রন : রক্তের হিমোগ্লোবিন তৈরির এটি একটি প্রধান উপাদান যা শরীরে বিশুদ্ধ অক্সিজেন সরবরাহ ও দূষিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড শরীর থেকে নির্গত করতে, বিভিন্ন এনজাইমের সহযোগী হিসেবে কাজ করে বিপাকীয় কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে শক্তি উৎপাদনে এবং শারীরিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হাড় এবং মাংসপেশি গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে বলে ভ্রƒণ-এর সঠিক বৃদ্ধির জন্য এটি খুবই প্রয়োজনীয়।

আয়োডিন : এটি থাইরয়েড গ্রন্থির হরমোন উৎপাদন করে থাকে যা শরীরবৃত্তীয় বিপাকীয় প্রক্রিয়াগুলো পরিচালনায় এবং শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি এবং সুস্থতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

জিঙ্ক : রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা বৃদ্ধিতে এই উপাদানটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কোষ বিভাজন ও পুনর্গঠনের মাধ্যমে শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে, ক্ষতসমূহ দ্রুত সারিয়ে তুলতে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণেও এটি ভূমিকা রাখে।

ম্যাঙ্গানিজ : রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন এনজাইমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এটি এনজাইমের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে, উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে, স্নায়ুর সমস্যা রোধে এবং লিভারের চর্বি হ্রাসসহ বিভিন্ন বিপাকীয় প্রক্রিয়ার সহায়ক হয়।

সেলেনিয়াম : শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে এটি ভিটামিন ‘ই’র সঙ্গে যুক্তভাবে ক্ষতিকর ফ্রি-রেডিক্যালস্কে প্রতিরোধ করে এবং থাইরয়েড হরমোনের বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে।

মলিবডেনাম : কোষকলার স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনায়, শরীরস্থ বর্জ্য অপসারণে, লোহিত রক্তকনিকা তৈরিতে এবং কিছুসংখ্যক অ্যামাইনো এসিড ভাঙ্গার ক্ষেত্রে অন্যান্য এনজাইমের সঙ্গে অণুঘটক হিসেবে কাজ করে।

কোবাল্ট : এটি রক্ত স্বল্পতা রোধে এবং বিভিন্ন সংক্রামক রোগ থেকে আরোগ্য লাভে, ভিটামিন বি-১২ শোষণে ও প্রক্রিয়াজাতকরণে, স্নায়ুস্থ কোষকলা সুরক্ষায় এবং হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে সহায়তা করে।

সিলিকন : সিলিকন শরীরস্থ কোষকলাগুলোকে একত্রে ধরে রাখার কাজে, পেশিবন্ধনী, ত্বক, সংযোজক কলা ও চোখের ¯œায়ুর অংশবিশেষ তৈরিতে, হাড় ও কোষকলাকে শক্তিশালী করে তুলতে ও দৃঢ়তা ধরে রাখতে ভূমিকা রাখে।

বোরন : হাড়ের ঘনত্ব বাড়াতে, ভিটামিন ‘ডি’কে সক্রিয় করে তুলতে এবং ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা সঠিক পর্যায়ে ধরে রাখতে সাহায্য করে।

নিকেল : শরীরে আয়রন শোষণে সক্রিয় থেকে এই উপাদানটি রক্তস্বল্পতা রোধে এবং হাড় শক্তিশালী করে তুলতে সহায়তা করে।

ক্রোমিয়াম : শরীরের শর্করা, চর্বি এবং আমিষের বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।

ভ্যানাডিয়াম : গ্লুকোজ এবং মেদজাতীয় পদার্থের বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় সহায়তা প্রদান, রক্তস্থ লোহিত কনিকা তৈরি এবং কোষকলার স্বাভাবিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে, রক্তের শর্করা ও সোডিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।

 

লেখক :

ড. জাকিয়া বেগম

পরমাণু বিজ্ঞানী ও মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ঢাকা, বাংলাদেশ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে