করোনাভাইরাস কি সত্যিই বাতাসে ছড়ায়?

0
655

প্রাণঘাতী করোনা মহামারিতে সমগ্র বিশ্বের মানুষ দেড় বছর ধরে উদ্বিগ্ন। যদিও মাঝখানে করোনা সংক্রমণের ঢেউ অনেকটা নিচের দিকে ছিল। ওই সময়টায় টিকার উৎপাদন ও বাজারজাতকরণও শুরু হয়েছিল। যদিও নিম্ন আয়ের দেশগুলোয় প্রয়োজনের তুলনায় ভ্যাকসিনের সরবরাহ কম। তারপরও মানুষ করোনার আতঙ্কে নিমজ্জিত রয়েছে। পরিসংখানগত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০ এপ্রিল পর্যন্ত পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ২ দশমিক ৭ শতাংশ পূর্ণ ভ্যাকসিনেটেড হয়েছে। ওই তারিখ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বে প্রায় ২১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ করোনার বিপরীতে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের টিকা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, ওই তারিখ পর্যন্ত প্রায় ১৬ লাখ ৭৮ হাজার ১৮৯ জন মানুষ করোনার বিপরীতে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের টিকা গ্রহণ করেছে, যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিদ্যমান জনসংখ্যার তুলনায় বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ভ্যাকসিনেটেডের হার কম। বাংলাদেশ সরকার জনসংখ্যার অনুপাতে ভ্যাকসিনেশন বৃদ্ধির জন্য অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও করোনায় বিশ্বের অনেক মানুষ বাংলাদেশের তুলনায় খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছে। আবার মৃত্যুর মিছিলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের নামও যুক্ত রয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার ৫৮৮ জন মানুষ মারা গেছে। ওই ডেটা অনুযায়ী দেশে মোট আক্রান্ত প্রায় ৭ লাখ ২৮ হাজার। যদিও আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা দিনের পর দিন অনাকাঙ্ক্ষিত হারে বেড়েই চলছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলমান, যা মানুষের মধ্যে অস্থিরতা দিনের পর দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বর্তমানে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, করোনাভাইরাস (সার্স কোভি-২) বাতাসের মাধ্যমে ছড়াচ্ছে। যদিও বিষয়টির ওপর দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার প্রয়োজন, তবুও বর্তমানে ভাইরাসটির চরিত্রগত পরিবর্তনে বাতাসে ছড়ানোর বিষয়টিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গবেষণায় আরও দেখা যাচ্ছে, যদি ভাইরাসটির ড্রপলেট ভারী হয়, তাহলে বায়ুতে ওই ভাইরাসটির স্থায়িত্ব কমে ভূপৃষ্ঠে দ্রুত নেমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ পদ্ধতিতে ভাইরাসটির বাতাসে ছড়ানোর আশঙ্কা কমে যায়। এ অবস্থায় সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক পরিধান, সারফেস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও জনসমাগম এড়িয়ে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে ভাইরাসটির নিউক্লিয়ার ড্রপলেট যদি অ্যারোসল আকারে বায়ুতে নির্গত হয়, তাহলে বাতাসের মাধ্যমে ভাইরাসটির ছড়ানোর বিষয়টিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বর্তমানে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ঘরের ভেতরে করোনার সংক্রমণ বাইরের তুলনায় বেশি। ঘরের ভেতর ভেন্টিলেশন কম হওয়ায় করোনার সংক্রমণ বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার করোনাভাইরাসটি এয়ার ফিল্টার ও বিল্ডিং ম্যাটারিয়ালসেও শনাক্ত হয়েছে। ওই ভাইরাসটি দ্বারা অ্যানিমেলও খাঁচার ভেতরে সংক্রমিত হয়েছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচির মাধ্যমে অ্যারোসল আকারে বায়ুমণ্ডলে নির্গত হয়। করোনাভাইরাসের বাতাসে ছড়ানো নির্ভর করে ওই নির্গত অ্যারোসলের পার্টিক্যাল সাইজের ওপর। ওই নির্গত অ্যারোসলের পার্টিক্যাল সাইজ কম হওয়ায় সার্স কোভি-২ ভাইরাসের ঘনত্ব বেড়ে যায়। পার্টিক্যাল সাইজ যদি ৫ মাইক্রোমিটার অথবা তার চেয়ে কম হয়, তাহলে বাতাসে করোনাভাইরাসের ঘনত্ব বেড়ে গিয়ে ৭ থেকে ৮ মিটার পর্যন্ত দূরত্বে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। অন্যদিকে পার্টিক্যালের সাইজ যদি ৬০ থেকে ১০০ মাইক্রোমিটার হয়, তাহলে ভাইরাসটি ড্রপলেট আকারে ২ মিটার দূরত্বে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে; কিন্তু ওই ড্রপলেটটিও পরবর্তী সময়ে হাঁচির মাধ্যমে ছয় মিটারের বেশি দূরত্ব বাতাসে অতিক্রম করতে পারে। সার্স কোভি-২ ভাইরাসটি সর্বোচ্চ ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত বাতাসে থাকতে পারে।

ফলে মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসে উৎপন্ন অ্যারোসলে বিদ্যমান করোনাভাইরাসটি বাতাসের মাধ্যমে ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। এ আশঙ্কায় সার্স কোভি-২ ভাইরাসটি বাতাসে ছয় ফুটের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করার ক্ষমতা রাখে। যদি তা-ই হয়, তাহলে করোনার মহামারিতে মানবজাতিকে ছয় ফুটের বেশি সামাজিক/ফিজিক্যাল দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। নতুবা বাতাসের মাধ্যমে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।

ভারতের ‘দ্য ডেলি হিন্দু’ পত্রিকা বিখ্যাত জার্নাল ‘ল্যানসেটের’ বরাত দিয়ে বলেছে, করোনাভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। ওই পত্রিকা আরও বলেছে, ৩২ দেশের প্রায় ২০০ বিজ্ঞানী ২০২০ সালের জুলাইয়ের দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সার্স-কোভি-২ ভাইরাসটির বাতাসের মাধ্যমে ছড়ানোর বিষয়ে অবহিত করেছিল। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ক্ষুদ্র পার্টিক্যালে বিদ্যমান ভাইরাসটির সংক্রমণের ক্ষমতা বেশি রাখে। গবেষণায় আরও দেখা যায়, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণ প্রকাশিত হওয়ার আগেই হাঁচি/কাশির মাধ্যমে কমপক্ষে প্রায় ৪৫ শতাংশ ভাইরাস অন্য মানুষের শরীরে স্থানান্তর হতে পারে। বিজ্ঞানীরা আরও বলেছেন, ভাইরাসটি বাতাসবাহিত হওয়ায় সুস্থ মানুষের শরীরে অতি সহজেই অ্যারোসলের মাধ্যমে প্রবেশ করার ক্ষমতা রাখে।

তাছাড়া করোনাভাইরাসের বাতাস ছাড়াও কনটাক্ট ও ড্রপলেট ট্রান্সমিশন হতে পারে। ড্রপলেট ট্রান্সমিশনে দেখা যায়, ছোট-বড় ড্রপলেট আকারে মানুষের শরীরে স্থানান্তরিত হতে পারে। উল্লেখ্য, ছোট ড্রপলেটটি নিউক্লিয়ার ড্রপলেট নামে পরিচিত। ফলে ওই ড্রপলেটটি বাতাসে মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত জীবিত অবস্থায় ছয় ফুটের বেশি দূরত্ব ট্রাভেল করতে পারে। যা হোক, করোনাভাইরাসটির বাতাসের মাধ্যমে স্থানান্তরের কিছু যৌক্তিকতা উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহুদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে এমন কিছু মানুষ মারা গেছে, যারা খুবই নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বসবাস করছিল। ওইসব আক্রান্ত ব্যক্তি কখনো মানুষের সংস্পর্শে যেত না। আবার ওই আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকে মারা গেছে। মোটা দাগে বলা যায়, বর্তমানে করোনার সার্স-কোভি-২ ভাইরাসটি বাতাসের মাধ্যমে ছয় ফুটের বেশি দূরে মানুষকে সংক্রমণের ক্ষমতা রাখে।

যাহোক, বাজারে ভ্যাকসিন আসায় করোনায় আক্রান্ত/আতঙ্কিত মানুষ বাঁচার স্বপ্ন দেখছে। যদিও ভ্যাকিনের সরবরাহ ও উৎপাদন প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। আবার অনেকেই ভ্যাকসিন গ্রহণ করায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ারও সম্মুখীন হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক কোম্পানির ভ্যাকসিনের উৎপাদনও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণের জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা। গবেষণার সময় কম পাওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে মানুষ কিছুটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়েছে। আবার ভ্যাকসিন গ্রহণ করার পরও মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে প্রায় ২ সপ্তাহ সময় লেগে যায়। আবার তৈরি হওয়া ওই অ্যান্টিবডি মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ২০ থেকে ২৫ সপ্তাহ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে।

বর্তমানে বিজ্ঞানীরা প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের ওপর গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন। আবার বিজ্ঞানীদের গবেষণায় প্রাপ্ত নতুন তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ভাইরাসটি বাতাসে ছড়ানোর ক্ষমতা রাখে। অন্যদিকে মিউটেশনের মাধ্যমে ভাইরাসটির নতুন নতুন জাত তৈরি হচ্ছে, যাদের সংক্রমণের ক্ষমতায় কিছুটা ভিন্নতাও পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ অবস্থায় ভাইরাসটির প্রতিকারের পাশাপাশি প্রতিরোধের ওপরও জোর দেওয়া উচিত। এখন উচিত জনসমাগম এড়ানো, ফিজিক্যাল দূরত্ব ছয় ফুটের বেশি রাখা, ভেন্টিলেশনের মাধ্যমে ঘরের ভেতর পরিষ্কার বাতাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা, সর্বদা মাস্ক পরিধান করা, স্যানিটাইজার দ্বারা ঘন ঘন হাত ধোয়া এবং করোনার টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করা।

করোনাভাইরাসটির বাতাসের মাধ্যমে ছড়ানোর প্রবণতা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের মতো গরিব দেশগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি রয়েছে। সেদিক দিয়ে চিন্তা করলে, ভাইরাসটি প্রতিকারের পাশাপাশি প্রতিরোধের ওপর জোর অব্যাহত রাখতে হবে। পরিশেষে বলা যেতে পারে, আগের চেয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় মানুষকে অধিকতর সচেতন হতে হবে, নতুবা বাতাসের মাধ্যমে ভাইরাসটির সংক্রমণের ক্ষমতা কমানো অনেকটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে।

ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম : সহযোগী অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে