শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, দীর্ঘদিন ঘরবন্দী
ক্সবাজারের বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলের কেজি শ্রেণির ছাত্র আয়ান ফারুক কয়েক মাস ধরে অনলাইনে ক্লাস করছে। সম্প্রতি ঢাকায় তার নানির বাসায় বেড়াতে এসেছে। অনলাইনে ক্লাস নিয়ে তার অনুভূতি জানতে চাইলে সে বলে ‘অনলাইনে ক্লাস করতে ভালো লাগে না। ক্লাসে ফিরে যেতে চাই। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে চাই। তাদের সঙ্গে স্কুলে খেলতে চাই। স্কুলের মিসদের কাছ থেকে সামনাসামনি পড়া বুঝে নিতে চাই।’
এই কথাগুলো শুধু আয়ান ফারুকের একার নয়। এটি বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর মনের কথা। মহামারীর কারণে দীর্ঘদিন ঘরবন্দী থাকায় একপ্রকার হাঁপিয়ে উঠেছে শিশু-কিশোররা। তারা আবার তাদের পুরনো ও স্বাভাবিক জীবন ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চায়। কিন্তু আপাতত পরিস্থিতি বিবেচনায় এটি সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, মহামারীর কারণে শিশুরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাববোধ দারুণভাবে অনুভব করছে। কোনোরকমে স্কুলের অধ্যয়নের বিষয়টি হয়তো স্কুল কর্তৃপক্ষ সামাল দিয়েছে। কিন্তু শিশুদের সামাল দিতে স্কুলের শিক্ষকদের পাশাপাশি অভিভাবকদের ওপরও দিনদিন চাপ পড়ছে। বিশেষ করে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের সামাল দিতে গিয়ে তাদের অভিভাবকরা খুব মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছেন। বুঝতে হবে যে ভার্চুয়াল ক্লাসরুমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা অনেক অভিভাবকের জন্য সহজ নয়। যদিও ভার্চুয়াল ক্লাসে শিক্ষার্থীরা ল্যাপটপ বা কম্পিউটারের মনিটরে তাদের বন্ধুদের দেখার সুযোগ পাচ্ছে কিন্তু সেখানে এই শিক্ষার্থীরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। আবার সব স্কুল অনলাইনে ক্লাস করাতে পারছে না। অনেক অভিভাবকদের পক্ষেও সন্তানকে অনলাইনে ক্লাস করানো সম্ভবও হচ্ছে না। কারণ সবার ইন্টারনেট সুবিধা নেই। ঢাকা ছেড়ে ইতিমধ্যে অনেকে পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। সেখানে ইন্টারনেট সুবিধাও নেই। এভাবে শিশুরা পাঠদানের ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছে। আবার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জীবন থেকে শিশুদের একটি বছর হারিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা কবে নাগাদ ঠিক হবে তা নিয়ে জানা নেই।
এক্ষেত্রে শিশু-কিশোররা নানা রকম মানসিক সমস্যার মধ্যে পড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, যেহেতু শিক্ষকরা সরাসরি শিশুর কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। এ জন্য অভিভাবকদের শিশুর দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যদিও সার্বক্ষণিক নজরদারির কারণে অভিভাবকদের চাপও বাড়ছে। আগে স্কুলে, পাড়া-মহল্লার খেলার মাঠে কিংবা প্রতিবেশীর বাড়ি গিয়ে একটি শিশু বেশ কিছু সময় কাটানোর সুযোগ পেত। যা এখন সম্ভব নয়।
এক্ষেত্রে কিছু শিশু যারা টুকটাক লিখতে শিখেছে তারা সোশ্যাল মিডিয়ার সাইটে নিজের মনের আবেগ প্রকাশ করে বিভিন্ন সময় ছোটখাটো পোস্ট দিচ্ছে। আবার আগের মতো স্বাভাবিকভাবে খেলাধূলা করতে না পেরে এবং অন্য শিশুদের সঙ্গে মিশতে না পেরে শিশুদের মধ্যেও উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বলেন, এই পরিস্থিতি সামাল দিতে অভিভাবক, শিক্ষক, প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনদের এগিয়ে আসতে হবে। সবাইকে কমপক্ষে ৩০ মিনিট করে সময় শিশুদের জন্য দিতে হবে। শিশুদের প্রতি এই মানুষগুলোর নজরদারি বাড়াতে হবে। পরিবর্তিত পরিবেশে শিশুদের জন্য যদি বিনোদনের ব্যবস্থা করা যায় এবং তাদের শিক্ষণীয় কিছু শেখানো যায় তাহলে শিশুদের ব্যস্ত রাখা যাবে। উদাহরণস্বরূপ বিভিন্ন অ্যাপার্টমেন্টে কমিউনিটি হল আছে সেখানে শিশুদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আবার বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় শিশুরা এখনো একে অন্যের সঙ্গে মিশছে। এক্ষেত্রে শিশুর অভিভাবক ও বয়স্ক আত্মীয়দের বিষয়টি নজরদারি করতে হবে। শিশুদের মাতিয়ে রাখতে বড়রা ছড়া শেখানো, একসঙ্গে গান করা এবং বিভিন্ন ঘরোয়া খেলার আয়োজন করতে পারে। তবে করোনা সংক্রমণে আশঙ্কার বিষয়টি মাথায় রেখে এই আয়োজন সীমিত পরিসরে দু-তিনজন শিশুর অংশগ্রহণে হতে হবে। আর আমরা যদি এগুলো শিশুদের জন্য করতে না পারি তাহলে তারা অন্যরকমভাবে বড় হবে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, একটি প্রজন্মের শিশুদের খুব বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে।
শিশুর বর্তমান মানসিক সংকট নিয়ে মনোচিকিৎসকরা আরও বলেন, করোনা সংক্রমণের ফলে দীর্ঘ সময় ধরে স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে বঞ্চিত হয়ে আমাদের শিশু-কিশোরদের মানসিক সমস্যা হচ্ছে। বিভিন্ন মানসিক সমস্যা আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে তাদের অভিভাবকরা কম এলেও এখানকার চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে কিন্তু ঠিকই অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিয়ে আসছেন। আবার অনেকে সন্তানের এই সমস্যায় যে মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে যাওয়া প্রয়োজন তা মনেও করছেন না।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, এই পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য অভিভাবকদের অবস্থা আমলে নিয়ে নিজেদের মতো করে পরিকল্পনা করতে হবে। দেখা যাচ্ছে যে কিছুক্ষেত্রে মা-বাবা যদি উভয়ই চাকরি করেন তাহলে তাদের কর্মস্থলে চলে যেতে হচ্ছে। তখন সন্তানের সঙ্গে ঘরে থাকার আর উপায় নেই। আবার কিছু পরিবারের অভিভাবকদের একজন কাজ করেন আরেকজন ঘরে থাকেন। ঘরে প্রচুর কাজ থাকে। এ জন্য সব পরিস্থিতি বিবেচনা করে অভিভাবকদের এখন একসঙ্গে বসে আলোচনা করে সন্তানের সময় যাতে ভালোভাবে কাটে তা মাথায় রেখে কিছু বিষয় পরিকল্পনা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আবার অনলাইনে ক্লাস, সামাজিক যোগাযোগ এবং বিনোদন সবই ইন্টারনেটভিত্তিক হয়ে পড়াটাও শিশুর জন্য নেতিবাচক। কারণ এতে একটি শিশু বেশি সময় অনলাইনেই কাটাচ্ছে। যার ফলে শিশুর আলাদা মানসিক চাপ পড়ারও আশঙ্কা আছে। এ জন্য শিশুর সামাজিক যোগাযোগ ও বিনোদন অনলাইনে না করে বিকল্প ব্যবস্থায় করা যায় কিনা তা ভাবতে হবে। বিশেষ করে, শিশুকে নিয়ে পারিবারিকভাবে গল্প করা এবং পরিবারের সদস্যরা একত্রে মিলে কোনো কাজ করা যেতে পারে। এ ছাড়া সাবধানতা অবলম্বন করে সীমিত পরিসরে কাছের কোনো স্থান থেকে শিশুকে নিয়ে বেড়িয়ে আসা যেতে পারে। এর বাইরে শিশুকে বই পড়তে উৎসাহিত করা যেতে পারে। এসব করে হয়তো শিশুর একঘেয়েমি কিছুটা হলেও দূর করা যাবে।