চিন্তা ভ্যাকসিন কেনার অর্থ নিয়ে

উন্নয়ন সহযোগীরা দেবে হাজার ৫০০ কোটি, বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও সংস্থান নিয়ে চ্যালেঞ্জ

মহামারী রূপ নেওয়া কভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের ঝুঁকির মধ্যেই এর ভ্যাকসিন কেনার অর্থ নিয়ে চিন্তায় পড়েছে সরকার। বছরজুড়ে করোনার অচলাবস্থার কারণে সরকারের আয় কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। অথচ করোনাকালে খরচ উল্টো আরও বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক শেষে ১৩ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে। ফলে চলতি বছরের বাজেটে ভ্যাকসিন কেনার জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও এনবিআর এর কতটুকু জোগান দিতে পারবে তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। অর্থ বিভাগের কর্র্মকর্তারা বলছেন, এ খাতের জন্য ২ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি হয়তো এনবিআর দিতে পারবে না। ফলে ভ্যাকসিন কেনার অর্থের জোগান দেওয়া এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, ভ্যাকসিন কেনার জন্য নানা দেনদরবারের পর উন্নয়ন সহযোগীরা ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা (১ বিলিয়ন ডলার) দেওয়ার মোটামুটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর বাইরে বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও এনবিআর ২ থেকে ৩ হাজার কোটির বেশি হয়তো দিতে পারবে না। কারণ রাজস্ব আদায় কমে গেছে। দেশের সব মানুষের জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে হলে সাড়ে ১৬ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনতে হবে। এতে মোট ব্যয় হবে আনুমানিক ১৪ হাজার কোটি টাকা। প্রথম দফায় সাড়ে ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কেনার প্রস্তুতি শুরু করেছে সরকার। এ জন্য ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশি একটি ওষুধ কোম্পানির প্রাথমিক চুক্তিও হয়েছে। এর জন্য বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হবে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ভ্যাসকিন পেতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দও আছে। প্রয়োজন হলে আরও অর্থ বরদ্দ দেওয়া হবে। অর্থের সংস্থান নিয়ে যে সমস্যার কথা বলা হচ্ছে তা কেটে যাবে। আমরা মনে করি অর্থ পেতে কোনো সমস্যা হবে না।’ এদিকে করোনার কারণে গত মাসে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সভায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের জন্য কভিডের ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে উন্নয়ন সহযোগীদের একাধিকবার অনুরোধ জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন পাওয়ার প্রতিও তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। অর্থ বিভাগের অন্য এক সূত্র জানান, করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন পেতে পে-উইদাউট পে উভয় পন্থায় এগোচ্ছে বাংলাদেশ। যদিও কোনো প্রতিষ্ঠান বা দেশই এখনো নিরাপদ ও কার্যকর ভ্যাকসিন উৎপাদনের শতভাগ নিশ্চয়তায় পৌঁছতে পারেনি। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো (নি¤œমধ্য আয়ের হিসেবে) বিনামূল্যে ভ্যাকসিন পাবে, যে তালিকায় বাংলাদেশের নামও রয়েছে। জাতিসংঘের আর্টিকেল অনুযায়ী যেসব দেশের মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ডলারের নিচে, সেসব দেশ এ ধরনের মহামারীর ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন পাবে। তবে ভ্যাকসিন উৎপাদানকারী কোনো প্রতিষ্ঠান বা দেশই বিনা পয়সায় কাউকে ভ্যাকসিন দেয় না, দেবেও না। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, মার্কিন সহায়তা সংস্থা ইউএসএইড, যুক্তরাজ্যের সহায়তা সংস্থা ইউকেএইড, বিশ্বব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ডিএফআইডিসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী বা অর্থায়নকারী কোনো প্রতিষ্ঠান বা দেশ এসব দেশকে অনুদান কিংবা সহায়তা হিসেবে ভ্যাকসিনের মূল্য পরিশোধ করবে। সে ক্ষেত্রে সহায়তা দানকারী প্রতিষ্ঠান, সংস্থা বা দেশ উৎপাদনকারী বা বিপণন প্রতিষ্ঠানকে মূল্য পরিশোধ করবে। কভিডের ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে এমন নিয়মই কার্যকর হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অবশ্য এ সুবিধার অংশ হিসেবেই উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশকে ১ বিলিয়ন ডলার দিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলে জানা গেছে। সূত্র জানান, যত দিন গড়াচ্ছে সরকারের ভিতরে অর্থ সংকট ততটাই প্রকট হচ্ছে। ফলে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এনবিআরে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকা, যা শতাংশের হিসাবে ২৫ শতাংশ। আর সেপ্টেম্বরের ২৫ তারিখ পর্যন্ত এনবিআরের রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪১ হাজার কোটি টাকা। অথচ এ সময়ে টার্গেট ছিল ৫৪ হাজার কোটি টাকা। এদিকে কভিডের ভ্যাকসিনের জোগান পেতে ১৫ সদস্যের একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করেছে সরকার। উচ্চপর্যায়ের এ গ্রুপ ভ্যাকসিন ক্রয়, অর্থের সংস্থান ও বিনা পয়সায় পাওয়ার বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে সরকারের করণীয় বিষয়ে পরামর্শ দেবে। এ গ্রুপের নেতৃত্ব দেবেন স্বাস্থ্য পরিষেবা বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব। এ ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য রাখা হয়েছে অর্থ বিভাগ, পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, ইআরডি, এলজিইডি, স্বাস্থ্য অধিদফতর, বিশ্বব্যাংক, ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউএসএইড, ডিএফআইডি ও আইসিডিডিআরবিকে। ওয়ার্কিং গ্রুপের কয়েক দফা কর্মপরিধিও ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভ্যাকসিন এবং যে কোনো নতুন পরিকল্পনা অনুমোদন। প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থানে সম্ভাব্য উৎস সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে তা নির্ধারণ এবং নতুন ভ্যাকসিন প্রবর্তনের জন্য জাতীয় নীতিকাঠামো তৈরি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতিটি দেশই নিজেদের অবস্থান থেকে চেষ্টা করছে ভ্যাকসিন তৈরি ও তা পাওয়ার। যে কোনো ভ্যাকসিন মানবদেহে প্রয়োগের আগে তা নিরাপদ ও কার্র্যকর কি না সেটি ঠিক করা হয়। এখানেও তাই হচ্ছে। এ জন্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এর লাইসেন্স দেবে। আবার বিপণনের জন্যও অনুমোদন লাগবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকেও এর অনুমোদন দিতে হবে। সর্বশেষ যে দেশ তার জনসাধারণের জন্য এটা ব্যবহার করবে সে দেশকেও এর অনুমোদন নিতে হবে। তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি দেশের ২০ শতাংশ মানুষ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন পাবে। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীরা পাবেন ফ্রন্টলাইনার হিসেবে। এখানে বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে দরিদ্র দেশগুলোর জিএভিআইর অর্থায়নের মাধ্যমে ভ্যাকসিন পাওয়ার সুযোগ রয়েছে, যা থেকে বাংলাদেশও এ সুবিধা পাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *