প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিন নেয়ার পরও আক্রান্তের ঝুঁকি আছে। তবে এর তীব্রতা মারাত্মক নাও হতে পারে। প্রথম ডোজ টিকা দেয়ার পর ৪ মাস (১১৯ দিন) পর্যন্ত প্রতিরোধ ক্ষমতা যথেষ্ট শক্তিশালী থাকে। এরপর থেকেই আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। তাই কার্যকর সুরক্ষার জন্য প্রথম ডোজ গ্রহণের নির্দিষ্ট সময় পর ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে। এছাড়া টিকা নেয়ার পরও মাস্ক পরা, হাত ধোয়া এবং শারীরিক দূরুত্ব বজায় রেখে চলাফেরা অব্যাহত রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
টিকাটি মানবদেহে হার্ড ইমিউনিটি (উচ্চ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) তৈরি করবে। যা করোনা রোধে সহায়ক হবে। হার্ড ইমিউনিটি যতদিন কার্যকর থাকবে ততদিন তেমন ভয় নেই। কিন্ত এরপর থেকেই ভয় বাড়বে। তবে আক্রান্তের শঙ্কা থাকলেও ভ্যাকসিন নিরাপত্তা হিসেবে কাজ করবে। অধিকতর সুরক্ষার জন্য যারা ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের ভ্যাকসিন নিতে হবে।
এমনকি ফ্লু ভ্যাকসিনের মতো এটাও প্রতি বছর নিতে হতে পারে। তবে গর্ভবতী নারী ও শিশুদের টিকা দেয়া নিরাপদ হবে কিনা সে বিষয়ে এখনও কাজ চলছে। ভ্যাকসিন নিয়ে দেশের মানুষের নানা ধরনের প্রশ্নর উত্তর খুঁজতে গিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রায় ১ বছর ধরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বিশ্ব। এতে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৭ কোটি ২৯ লাখ ছাড়িয়েছে। এ মহামারী থেকে বাঁচতে একটি কার্যকর ভ্যাকসিনের জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছেন। ইতোমধ্যে চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বেশকিছু প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। তবে স্বল্প সময়ে উদ্ভাবিত এসব ভ্যাকসিন নিয়ে মানুষের মনে রয়েছে নানা সংশয়। এটা ঠিকমতো কাজ করবে কিনা, একবার দিলে কতদিন রোগমুক্ত থাকা যাবে, নাকি প্রতি বছর দিতে হবে, কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা, শিশু ও গর্ভবতীরা এ ভ্যাকসিন নিতে পারবে কিনা- এ ধরনের অনেক প্রশ্ন নিয়ে
ড. ফেরদৌসী কাদরী বলেন, একবার ভ্যাকসিন দিলে কোভিড-১৯ হবে কিনা ব্যাপারটি এখনও অজানা। এখন পর্যন্ত দেখা গেছে, শুধু গুটি বসন্তের ক্ষেত্রে একবার টিকা দেয়ার পর রোগটি আর হয় না। এছাড়াও, কোভিড-১৯ এর সম্ভাবনাময় কোনো টিকার কার্যকারিতাও ১০০ ভাগ নয়। সুতরাং একবার টিকা নিলেও রোগটিতে আক্রান্তের আশঙ্কা থেকে যায়। অন্যদিকে, আমরা ফ্লু টিকার কথা ভাবতে পারি। যেখানে টিকা দেয়ার পরও কেউ সংক্রামিত হলে রোগের তীব্রতা মারাত্মক হয় না। এখন থেকে মাস্ক পরা, হাত ধোয়া এবং শারীরিক দূরুত্ব বজায় রাখা চালিয়ে যেতে হবে।
প্রতি বছর ভ্যাকসিন নিতে হবে কিনা এ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কোভিড-১৯ টিকা আমাদের কতদিন পর্যন্ত সুরক্ষা দেবে তা এখনও অজানা। এমন হতে পারে, ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো প্রতি বছর টিকা নেয়ার দরকার হতে পারে আবার নাও হতে পারে। এটা নির্ভর করবে টিকার সুরক্ষার স্থায়িত্বকাল কতদিন তার ওপর। এছাড়াও, এটি হার্ড ইমিউনিটি/প্রটেকশনের ওপর নির্ভর করে। যা সাধারণ সংক্রমণ ও টিকার মাধ্যমে গড়ে ওঠে।
কোভিড-১৯ টিকার মাধ্যমে সৃষ্ট অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (টি সেল, সেলুলার রেসপন্স) কতদিন কার্যকর থাকবে সে বিষয়ে গবেষণা চলমান। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ৬ মাস পরও রোগীর শরীরে অ্যান্টিবডি ও সেলুলার রেসপন্সের স্থায়িত্ব দেখা গেছে। অন্যদিকে টিকার বিষয়ে আন্তর্জাতিক জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে দেখা গেছে, মর্ডানার কোভিড-১৯ টিকার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রথম ডোজ টিকা দেয়ার ১১৯ দিন পরও যথেষ্ট শক্তিশালী। ফেজ-৩ পরীক্ষার আওতায় থাকা অন্য টিকাগুলোর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার স্থায়িত্বও যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক।
যারা এরই মধ্যে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন তাদেরও ভ্যাকসিন নিতে হবে বলে জানিয়েছেন ড. ফেরদৌসী কাদরী। কারণ তাদের জন্যও এ টিকা নিরাপদ এবং উপকারী। যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কতদিন পর্যন্ত কার্যকর থাকবে তা এখনও অজানা। অন্যসব টিকার মতো এটির ক্ষেত্রেও যারা আক্রান্ত হয়েছেন এবং হননি সবাইকে টিকা নিতে হবে।
শিশু ও গর্ভবতী নারীদের জন্য ভ্যাকসিন কতটা নিরাপদ জানতে চাইলে বিজ্ঞানী বলেন, টিকার সুরক্ষা ও কার্যকারিতার প্রাথমিক পর্যায়ের গবেষণায় শিশু ও গর্ভবতী নারীদের যুক্ত করা হয় না। ফেজ-৩ ট্রায়ালে থাকা টিকাগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। যখন প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য টিকা নিরাপদ ও কার্যকরী প্রমাণিত হয় তখন শিশু ও গর্ভবতী নারীদের নিয়ে আলাদা গবেষণা হয়। তখনই মূলত টিকার সুরক্ষা ও কার্যকারিতার পাশাপাশি এর ডোজ নির্ধারণ করা হয়। এছাড়াও, ফেজ-৩ ট্রায়ালে অংশ নেয়া যেসব মহিলা পরে গর্ভধারণ করেছেন তাদের মাধ্যমেও গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে টিকার নিরাপত্তার বিষয়টি জানা যাবে।
ভ্যাকসিন কেন দুই ডোজ দিতে হবে, এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের শরীরে যখন নতুন কোনো বস্তু (জীবাণু) প্রবেশ করে, তখন শরীর সেই বস্তুর প্রতি এক ধরনের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া (প্রাইমারি রেসপন্স) দেখায়। একই সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি শুরু করে। আর দ্বিতীয়বার যখন সেই একই বস্তু প্রবেশ করে তখন তা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। এর ফলে আইজিজি অ্যান্টিবডি আরও পরিপক্ক হয় এবং তার স্থায়িত্ব দীর্ঘ হয়। একাধিক ডোজের টিকা প্রয়োগ একটি প্রচলিত পদ্ধতি। গবেষকরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির সঙ্গে সমন্বয় করে টিকার বিভিন্ন ডোজের মধ্যে সময়ের পার্থক্য নির্ধারণ করে থাকেন। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন টিকার ক্ষেত্রে ১৪ দিন, ২৮ দিন বা ১ বছর পর দ্বিতীয় ডোজ বা বুস্টার ডোজ দেয়ার প্রচলন রয়েছে।
দুই ডোজে আলাদা অ্যান্টিবডি তৈরি হবে কিনা এসংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দুই ডোজ টিকা আলাদা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করবে ব্যাপারটি এমন নয়। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে শরীরে প্রথমে আইজিএম অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তারপর আইজিজি অ্যান্টিবডি, বি-সেল, টি সেল ও মেমোরি সেল তৈরি হয়। বিষয়টি খুব জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়ে থাকে। এখনও সার্স কোভ-২ ভাইরাস বা কোভিড-১৯ রোগটির বিষয়ে বিজ্ঞানীদের অনেক কিছুই অজানা। তাই সাধারণভাবে বলা যায়, টিকার দ্বিতীয় ডোজ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত এবং দীর্ঘস্থায়ী করে।