ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা আইসিইউ ইউনিটে আগুন

0
564
dmc
Spread the love

আগুনে পুড়ে গেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকা করোনা ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ)। এতে তিন রোগীর করুণ মৃত্যু হয়েছে। এরা হলেন- ৮ নম্বর বেডের দিনাজপুরের কিশোর রায় (৬৮), ১১ নম্বর বেডে ঢাকার দক্ষিণখানের আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (৪৮) এবং ৯ নম্বর বেডে মানিকগঞ্জের কাজী গোলাম মোস্তফা (৬৩)। আইসিইউ থেকে স্থানান্তরের সময় এই তিনজন রোগী মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন  হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক। তিনি বলেন, এরা কেউ দগ্ধ হননি। গতকাল সকাল ৮টা ১০ মিনিটে এ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এ সময় পুরো হাসপাতালে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রোগী এবং তাদের স্বজনরা প্রাণ ভয়ে দিগবিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। প্রায় ২০ মিনিটের আগুনে করোনা ইউনিটের আইসিইউ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে যায়।

রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, করোনা ইউনিটের ভিতরে থাকা ফায়ার এক্সটিংগুইশারগুলো সঠিকভাবে কাজ করেনি। নার্স এবং স্টাফদের অধিকাংশই নিজেদের রক্ষায় সড়ে পড়ে। আগুন লাগার পর আইসিইউ থেকে রোগীদের দ্রুত না সরানোয় ধোঁয়ার মধ্যে দমবন্ধ হয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ওই রোগীদের অবস্থা এমনিতেই ‘ক্রিটিক্যাল’ ছিল। তবে দমবন্ধ হয়ে তাদের মরার কারণ নেই, তারা ভেন্টিলেটরে ছিলেন। আগুনের ঘটনায় হাসপাতালের এনেসথেসিওলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. মোজাফ্ফর হোসেনকে প্রধান করে ১০ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। সংস্থাটির সদর দফতরের উপপরিচালক (অ্যাম্বুলেন্স) নূর হাসানকে প্রধান করে চার সদস্যের এই কমিটি করা হয়েছে। ঢামেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হকের নির্দেশে গঠিত কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক জানান, আইসিইউতে আগুন লাগার পর ধোঁয়া বের হয়। হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রোগীদের সেখান থেকে বের করে আনেন। হাসপাতালের অন্য আইসিইউতে তাদের স্থানান্তর করা হচ্ছিল। এ সময় রোগীদের মধ্যে তিনজন মারা যান। অক্সিজেনের লাইন থেকে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। এতে আইসিইউতে থাকা অনেক যন্ত্রপাতি পুড়ে গেছে। অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দুপুরে পুড়ে যাওয়া আইসিইউ ইউনিট পরিদর্শনে আসেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। পরে তিনি আগুনের বিষয় জানতে হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলেন।

গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, আগুনে আইসিইউ কক্ষটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো বিছানায় খাবারের বাটি ও সকালের নাস্তায় চামচও পড়ে থাকতে দেখা যায়। আবার কোনো কোনো টেবিলে ওষুধের পুরো বাক্স পড়ে থাকতে দেখা যায়। পুরো ফ্লোরে জমে ছিল পানি। ওপর থেকে খসে পড়া হার্ডবোর্ডের সেলিংগুলোও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। কার্ডিয়াক এইচডিইউতে থাকা আইসিইউটি করোনা রোগীদের জন্য বরাদ্দ ছিল। ১৫ বেডের ওই আইসিইউতে মোট রোগী ছিলেন ১৪ জন। আর একটি বেড ছিল হাসপাতালের স্টাফদের জন্য সংরক্ষিত। সেখানকার ওয়ার্ড মাস্টার মো. রিয়াজ জানান, আইসিইউতে যে রোগীর অবস্থা অন্যান্যদের তুলনায় বেশি খারাপ থাকে, তাকে হাইফ্লো নেইজল অক্সিজেন কেনুলা দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ ১০০ লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব। ১২ নম্বর বেডের রোগীর সেটি লাগানো ছিল। ওই মেশিনের পাশে রোগীর স্বজন একটি পাত্রে পানি গরমও দিয়েছিলেন। সকাল ৮টার দিকে ওই মেশিনে শর্টসার্কিটে স্পার্ক করে, এতে রোগীর এক স্বজন আতঙ্কিত হয়ে আগুন নেভাতে সেখানে একটি আঘাত করে। পরে ওই আঘাত গিয়ে লাগে গরম পানির পাত্রে। এতে পানির সঙ্গে আগুনও চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তে পুরো আইসিইউ ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়। আতঙ্কিত হয়ে রোগীর স্বজনরা দিগবিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। তাদের ওয়ার্ডবয় ও কর্তব্যরত নার্সরা যে যেভাবে পেরেছে রোগীদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। ধোঁয়া থেকে বাঁচতে তারা দুই দিকের জানালার কাচ ভেঙে ফেলে। একজন ছাড়া সব রোগীকে তারা বের করতে সক্ষম হন। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আটকে পড়া একজনকে উদ্ধার করে। ঘটনার সময় সেখানে তিনজন চিকিৎসক, আটজন নার্স ও চারজন ওয়ার্ডবয় দায়িত্বে ছিলেন। আইসিইউর ৯ নম্বর বেডে ভর্তি ছিলেন গোলাম মোস্তফা নামে এক রোগী। আগুনের ঘটনায় তাকে অন্য আইসিইউতে স্থানান্তরের পর তার মৃত্যু হয়। তার শ্যালক আরিফুজ্জামান বলেন, দুলাভাই মারা গেছেন ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে। আমরা বাইরে ছিলাম। ঘটনার সময় তিনি জীবিত ছিলেন। গোলাম মোস্তফা গত ১১ মার্চ ব্রেন ও ফুসফুসের সমস্যা নিয়ে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি হন। করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ হওয়ায় করোনা ইউনিটের ওই আইসিইউতে নেওয়া হয়। ১০ নম্বর বেডে ভর্তি ছিলেন মাহবুব মন্ডল। তিনি বেঁচে আছেন। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। আগুন লাগার সময় বাবার পাশে ছিলেন ছেলে ইসলামুল হক। ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক (ডিডি) দেবাশীষ বর্ধন বলেন, হাসপাতালের নতুন ভবনের তৃতীয় তলায় করোনা রোগীদের জন্য বরাদ্দ আইসিইউতে অগ্নিকান্ডের খবরে মোট পাঁচটি ইউনিট পাঠানো হয়। তবে প্রচ- ধোঁয়ার কারণে আগুন নির্বাপণে বেগ পেতে হয়েছে। আগুনের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বলেন, আইসিইউর বেড প্রতি খরচ ধরেন প্রায় ২০ লাখ টাকা। যদি ১০ লাখ টাকা করেও ধরি তাহলে সবমিলে এতে ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক প্রায় ২ কোটি টাকা। এ আইসিইউ এই মুহূর্তে চালানোর মতো অবস্থা নেই। ঘটনা তদন্তের পর নতুনভাবে, আরও উন্নত করে এই আইসিইউ চালু করা হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে